আজ বিশ্ব বাবা দিবস। দিবসটিতে আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। যিনি এ বছরই দুনিয়ার সফর শেষে পরলোকে পাড়ি জমান। তাঁর স্মৃতি যেমন আনন্দের তেমনি বেদনার। বাবার কিছু চাওয়া পূরণ করতে না পারার দুঃখ এখনও প্রতিদিন আমাকে কাঁদায়।

আমার বাবা ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়তে পারেননি আর্থিক অভাব-অনটনের জন্য। দাদা মারা যাওয়ার আগে ছেলের বউ দেখে যাবেন, এই ভেবে বাবাকে আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করার আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন। হয়েছেও তাই; তিনি মারা গেছেন অল্প সময়ের ব্যবধানেই। ছাত্রাবস্থা থেকেই সামাল দিতে হয়েছে পরিবার এবং লেখাপড়া। আলিম, ফাজিল, কামিল এবং বিএ পাস করেছিলেন বিয়ের পরেই। তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন বাবা; ছিলেন লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজের ভিপি। প্রত্যাশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবেন। এই আশায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। মাদ্রাসায় বোর্ড স্ট্যান্ডধারী বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়নি আমাদের ভরণপোষণের চিন্তায় মগ্ন থাকার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার সময় কলাভবনের সিঁড়িতে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে লিখে এসেছিলেন, 'সিঁড়ি আমি তোকে অতিক্রম করতে পারিনি, একদিন আমার ছেলেকে দিয়ে হলেও তোকে অতিক্রম করাব।'

বাবার সে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। বাবার বড় দুই ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বড় ভাই ইসলামের ইতিহাস বিভাগে এবং মেজো ভাই ভর্তি হলেন আইন বিভাগে। আমারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছিল, তবে ভালো বিষয়ে পড়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই।

সামান্য চাকরি দিয়ে ১০ ভাইবোনকে পড়ালেখা করানো বাবার পক্ষে অসম্ভব ছিল। দাদাও শিক্ষক ছিলেন, তাই সম্পদ বলতে তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি। বাবা চট্টগ্রামে চাকরি করতেন। চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলসের স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে মিলের মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবা সামাজিক নানা কাজে অংশ নিতেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বাবাকে খুব ভালোবাসতেন।

বাবা সব ছেলেমেয়েকেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বাবা ছিলেন কঠোর প্রকৃতির। বাবার ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতাম আমরা। সাধারণত এখনকার সময়ে বাবা-সন্তানের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যায়, তা ছিল না আমাদের। তবে আমাদের প্রতি বাবার ভালোবাসা একটু বেশিই ছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাবা। মৃত্যুর প্রায় দু'মাস আগে বাবা কিছুটা অসুস্থ হয়েছিলেন। ল্যাব এইড হাসপাতালে প্রায় এক সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু জটিল কোনো সমস্যাই ধরা পড়েনি। তবে ঢাকায় হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে ভাইবোনসহ সবার কাছে বাবা বলেছিলেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমিও তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর মোটামুটি সুস্থ বাবা নিজেই দাদার কবরস্থানের পাশের গাবগাছ কাটিয়েছেন। সেখানেই তাঁকে কবর দিতে বলে গেছেন। আল্লাহ বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।