প্রতি বছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। আগের যে কোনো সময় বিবেচনায় শরণার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা ও সংকটের মাত্রা পূর্বাপেক্ষা দুর্বিষহ। বিশেষ করে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট আরও বাড়ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে ইতোমধ্যে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ শরণার্থী হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছর শরণার্থীদের নিরাপত্তার অধিকারের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবারের শরণার্থী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য :এ পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের নিরাপত্তা খোঁজার অধিকার রয়েছে- তারা যেই হোক, যেখান থেকেই আসুক এবং যখনই তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হোক না কেন। অর্থাৎ যে কেউ, যেখানেই হোক, যখনই হোক, প্রত্যেকের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার রয়েছে।

যখনই শরণার্থী প্রসঙ্গ আসে; দুটি বিষয় কাজ করে:একটি পাঁচ দশকের পুরোনো, আরেকটি এখনও চলমান। ১৯৭১ সালে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অমোঘ বাস্তবতায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। আর স্বাধীনতার এক দশক পর থেকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আগমন শুরু হয়। ১৯৭০ দশকের শেষের দিক থেকে রোহিঙ্গাদের দলগত আগমন তথা তাদের নিজ জন্মভূমি আরাকানে সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সহিংসতা থেকে জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশে নিরাপত্তা অন্বেষণ বা আশ্রয় গ্রহণের প্রচেষ্টা অদ্যাবধি অব্যাহত।

ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে রোহিঙ্গাদের আগমন, আশ্রয়দান ও আতিথেয়তা অনেকটা স্বাভাবিক ও সহজাত। তবে সাম্প্রতিক বাস্তবতায় তা ভিন্ন মাত্রায় পর্যবসিত। বিশেষত ২০১৭ সালের আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন কিনা মিয়ানমারের রাখাইনে সৃষ্ট গণহত্যাজনিত আক্রমণ থেকে পালিয়ে একযোগে অল্প কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে নিরাপত্তা বা আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস উখিয়া- টেকনাফের স্থানীয়দের সামগ্রিক জীবনে প্রভূত প্রভাব সৃষ্টি করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন আগের মতো আর নিরাপদ থাকছে না। কিছুদিন পরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘাতের ঘটনা এবং স্থানীয় সমাজেও তার বিস্তার ঘটছে। তা ছাড়া চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ নানাবিধ অপরাধমূলক ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়দের জীবনযাপন, অর্থনীতি, শিক্ষা ছাড়াও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরেও শরণার্থীদের চাপের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে প্রতিভাত। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের জীবন এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের জীবনকে নিরাপদ রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

রোহিঙ্গাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব কেবল বাংলাদেশের নয়। আন্তর্জাতিক ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে এ লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শরণার্থীদের নিজ গৃহে ফেরানোর সম্মানজনক ও আইনগত পন্থা বাস্তবায়ন ব্যতীত তথা সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শরণার্থীদের নিরাপত্তা প্রদান মানে তাদের জীবন রক্ষার জন্য প্রথমত আশ্রয় প্রদান, মৌলিক চাহিদার নানাবিধ ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশ সহজ ও নিশ্চিত করা এবং কোনোভাবেই তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য জোর না করা। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ এসব সূচকে মানবাধিকার সুনিশ্চিত করে আসছে। তবে এ অবস্থার অনিশ্চিত গন্তব্য রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি কারও জন্যই সুখকর হতে পারে না। এই অচলাবস্থার অবসান এখন সময়ের দাবি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেবল বাসস্থান বা খাদ্য সংস্থানই যথেষ্ট নয়; তাদের প্রত্যাবাসনে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ অনিবার্য। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের পক্ষে যতটা উচ্চকণ্ঠ ও মনোযোগী; রোহিঙ্গাদের পৈতৃক ভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুকূলে ও কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়।

ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গাদের চাপ সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের উখিয়া-টেকনাফ থেকে অন্যত্র (যেমন ভাসানচর) স্থানান্তর কিংবা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার, তাদের বেড়া নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সাময়িক প্রশস্তি মিললেও স্থায়ী সমাধান প্রত্যাবাসনের মাঝেই নিহিত। সুতরাং বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে একাগ্র হতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের চাপ বাংলাদেশের ওপর, তাই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কূটনৈতিক পন্থায় বাধ্য করতে হবে যাতে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনকভাবে নিজভূমে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা মিয়ানমার ও মিয়ানমারের বন্ধু বা সহযোগী রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করে। কূটনৈতিকভাবে এগোতে না পারলে বাংলাদেশে শরণার্থীদের এই চাপ বহন করে নিতে হবে বহুকাল, যা বাংলাদেশের পক্ষে অসহনীয়। কেবল আশ্রয় প্রদানের মাঝে কৃতিত্ব নয়; কূটনৈতিক পন্থায় নিজেদের দক্ষতা প্রকাশ করতে না পারলে বাংলাদেশ সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হলে একদিকে রোহিঙ্গাদের জীবন আরও অমানবিক ও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে; অন্যদিকে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা সামগ্রিকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০২২ সালের মূল প্রতিপাদ্য সামনে রেখে তাই শরণার্থীদের উৎস, তাদের পরিচয় ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার শরণার্থীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক জীবনবিধানের সব ব্যবস্থা গ্রহণ আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কর্তব্য। আশা করা যায়, অতীতের ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলাদেশ ও এর জনগণ এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মানবিক ও কূটনৈতিকভাবে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা আরও কার্যকর ও কর্মোদ্যোগী হওয়া কাম্য। পৃথিবীজুড়ে যেভাবে শরণার্থীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে; সেভাবে সহযোগিতার খাত, ক্ষেত্র ও আগ্রহ বারবার বদল না করে সব শরণার্থীর জীবনের নিরাপত্তার অনুকূলে সম্ভব সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণে আরও তৎপর হওয়া মানবিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজে শরণার্থীদের চাপ লাঘব করতে স্থানীয় সমাজ-সংস্কৃতি বিবেচনায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ তুলনামূলক ফলদায়ক। পৃথিবীর সব অঞ্চলের শরণার্থীদের এক চোখে না দেখে, বিভিন্ন অঞ্চলের (উত্তর-দক্ষিণ) শরণার্থীদের জন্য অঞ্চল-সমাজভেদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা উচিত।

ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
alactg@gmail.com