
হাজারো সমস্যার দেশ বাংলাদেশের এক নিম্ন- মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার সুবাদে সমস্যার পাহাড় মাথায় করেই আমার বেড়ে ওঠা। প্রধান সমস্যা অবশ্য ছিল টাকার অভাব। খাদ্যের অভাব তেমন ছিল না। কারণ, আমাদের পরিবার ছিল খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রায় বলছি এ জন্য যে, মাঝেমধ্যেই সাময়িক খাদ্যাভাব দেখা দিত। প্রধানত আউশ ও আমন ধান ওঠার আগে আগে। আমাদের জমিতে যে পরিমাণ ধান হতো, তাতে ভাতের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অভাব হতো তখনই, যখন বন্যা বা খরায় ফসলহানি হতো। ছোটবেলায় এ দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগই দেখেছি ঘন ঘন। বন্যা তো ফি-বছর লেগেই থাকত। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক বন্যা। কিন্তু মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক বন্যায় ফসলহানি হতো বেশ। ফসল মানে ধান। অভাব বলতে ভাতের অভাব। হাভাত শব্দটা এখান থেকেই এসেছে। দুর্ভিক্ষ অবশ্য নিজ চোখে দেখিনি। গল্প শুনেছি আর বইয়ে পড়েছি।
দেশে এখন খাদ্যের অভাব পূরণ হয়েছে। ফলন বেশি। তবে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করার সময় চলমান রাসায়নিক কৃষির বিকল্প খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, দেশের প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচাতে সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে আউশের আবাদ বাড়াতে হবে। এতে হয়তো ধানের মোট উৎপাদন কিছুটা কমবে, যা শুনে দেশের রাজনীতিবিদ এবং পরিকল্পনাবিদরা হয়তো হইহই করে উঠবেন। কারণ, তাঁরা এমনকি বরেন্দ্র কিংবা পাহাড়ি এলাকায়ও সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদ প্রসারে বদ্ধপরিকর। অবশ্য অগ্নিকন্যাখ্যাত সাবেক কৃষিমন্ত্রী আউশ আবাদের প্রতি জোর দিয়েছিলেন বেশ। কৃষকদের প্রণোদনাও দিয়েছিলেন। এতে দেশে উচ্চফলনশীল আউশের আবাদ বেড়েছে। আউশ আবাদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা এই যে, এতে সেচ কম লাগে। আগের দিনের আউশ বৃষ্টিনির্ভর হলেও আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের আউশের বৃষ্টিনির্ভর চাষ করা যায় না। অল্পস্বল্প সেচ লাগেই। আউশ লাগানোর পর মে-জুন মাসে যখন পুরোদমে বৃষ্টি শুরু হয়, তখন আর সেচ লাগে না। তবে বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কার কারণে নিচু বা মাঝারি নিচু জমিতে উফশী আউশ লাগানো না গেলেও পানির সঙ্গে বাড়ে এমন আউশ লাগানো যায়। আমনের ক্ষেত্রেও তাই। এরূপ আউশ ও আমন ধান সম্পূর্ণ জৈব এবং আজকাল জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় যে ইকোসিস্টেম-ভিত্তিক অভিযোজনের কথা বলা হচ্ছে, সেই নিরিখে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যেতে বসা আউশ ও আমনের এই জাতগুলোর সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ব্যাপক গবেষণাকর্ম জরুরি। সেটা তেমন হচ্ছে বলে মনে হয় না। দেশি আউশ বা আমন জাতগুলোর ফলন কম বিধায় হয়তো তা গবেষকদের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পায় না। কিন্তু পুষ্টি, স্বাদ এবং আমাদের আবহমান বাংলার খাদ্যসংস্কৃতি সর্বোপরি নিরাপদ খাদ্য তথা খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
যাহোক, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সৃষ্ট পানীয় জলের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে করা কর্মগবেষণা এবং সার্বিক প্রেক্ষাপট ও অবস্থা বিবেচনায় সেচনির্ভর বোরো আবাদ কমিয়ে দেশে আউশ ও আমন আবাদে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ইকোসিস্টেম-ভিত্তিক অভিযোজনের কৌশল হিসেবে বিলুপ্তপ্রায় অথচ অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও অধিক পুষ্টিমানসম্পন্ন দেশি জাতগুলোর সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা এখন সময়ের দাবি। এ জন্য দেশের সাধারণ ক্রপিং প্যাটার্ন হওয়া উচিত উঁচু জমির জন্য উফশী, আউশ-উফশী, আমন-রবিশস্য এবং নিচু জমির জন্য (দেশীয় উন্নত জাতের) আউশ- (দেশীয় উন্নত জাতের) জলি আমন-বোরো। বিলাঞ্চলে ধান ও প্রাকৃতিক মাছের সমন্বিত চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের চালের চাহিদা মেটাতে সেচনির্ভর বোরো ধানের প্রসারে যে পরিমাণ কসরত করা হচ্ছে এবং তার ফলে আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের যে ক্ষতি প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে, তা নিয়ে ভেবেচিন্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চলে যাচ্ছে। সময় গেলে সাধন হবে না- লালনের এ কথা এখনও যদি আমরা না বুঝি, তা হবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
শাহীদুল ইসলাম: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন