ইসলাম মানবতার ধর্ম। শান্তি, সৌহার্দ্য, সাম্য-মৈত্রী, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার-নৈতিকতা, মূল্যবোধগত উৎকর্ষ, অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিকতা হলো ইসলামের পরম আদর্শ। ইসলামী জীবনদর্শনে বিশ্বমানবতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানব সভ্যতায় সম্প্রীতির পৃথিবী আর সর্বজনীনতার প্রকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে ইসলাম। ইরশাদ হচ্ছে- 'আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিমাতি ওয়া রাদিতু লাকুমুল ইসলামা দিনা।' অর্থাৎ, আজ আমি তোমাদের জীবনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর প্রদত্ত আমার অনুগ্রহকেও সম্পূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের জন্য জীবনপদ্ধতি হিসেবে ইসলামকেই মনোনীত করে দিলাম। মানবমণ্ডলীর জন্য মহান স্রষ্টার মনোনীত এই ইসলামের মূল মর্মবাণীই হচ্ছে কল্যাণকামিতা, মানবিকতা। বলা হচ্ছে, 'আদ্দিনু ওয়ান্নাসিহা।' অর্থাৎ ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা সর্বদাই কল্যাণের কথা বলে, মানবিকতার জয়গান গায় এবং ভালোবাসার পূর্ণতা দান করে। ইসলাম, কোরআনে কারিম আর মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি বাণী ও বক্তব্যে বিশ্বমানবতার প্রকৃত স্বরূপ পরিস্ম্ফুট। কোরআনে কারিমকে বলা হয়, 'হুদাল্লিন্নাস' তথা সমগ্র মানবতার জন্য পথপ্রদর্শক, আর বিশ্বনবী (সা.)-কে বলা হয় 'রাহমাতুল্লিল আলামিন' তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য করুণাস্বরূপ। এতে ইসলামের সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন রূপটিই সমহিমায় প্রকাশিত হয়ে থাকে এবং মানবতার পরিশুদ্ধ সুরটিই তাতে বাগ্ধময় হয়ে ওঠে।
ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত পয়গম্বর হজরত ইবরাহিম (আ.) যিনি মুসলিম নামটির প্রবর্তন করেছেন, তাঁর জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনায় ইসলামে মানবিকতার বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। ইবরাহিম (আ.)-এর স্বভাব ছিল মেহমান নিয়ে খাবার গ্রহণ করা। কোনো এক সময় এমন হলো, তিনি মেহমান পাচ্ছেন না, আর তিনি খাদ্যও গ্রহণ করছেন না। অবশেষে মেহমান একজন এলো। তিনি পরমানন্দে আগন্তুক মেহমান নিয়ে খাবার খেতে বসলেন এবং মেহমানকে প্রভুর নামে খেতে বললেন। মেহমান এতে বিরক্তি ও অপারগতা প্রকাশ করে খাবার না খেয়েই চলে যেতে উদ্যত হলে প্রিয় নবীর প্রতি প্রত্যাদেশ এলো মেহমানকে তাঁর ইচ্ছামতো খাদ্য গ্রহণের স্বাধীনতা দিতে। নবী তাই করলেন। মেহমান খাবার খেয়ে যাওয়ার সময় নবীকে এর কারণ জানতে চাইলে বিষয়টি তাঁর কাছে ব্যক্ত করা হলো এবং তিনি তখন অজ্ঞানতা আর খোদাবিমুখতার পথ পরিহার করে নিজেকে শুধরে নিলেন। মানবতার পরম সুহৃদ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপস্থিতিতে মসজিদে অমুসলিম জনৈক ব্যক্তি প্রস্রাব করতে উদ্যত হলে সাহাবিরা যখন এর সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দয়ার নবী তখন তাঁদের থামিয়ে দিলেন। লোকটি কাজ সেরে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন নবীজি তাঁকে বুঝিয়ে বললেন- এটি আমাদের উপাসনার জায়গা, যা আমাদের কাছে খুবই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র। এখানে ময়লা হলে আমাদের কষ্ট লাগে। ওই ব্যক্তি যা প্রমাণ করতে এসেছিল, তা সে পেয়ে গেল।
মহানবী (সা.) ইসলামের আলোকে যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তার ভিত্তি ছিল সততা, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মানবিকতাবোধ। ইসলামে পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হলো নামাজ; আর সেই নামাজের মাধ্যমে আমরা মানবিকতা ও সাম্যের এক প্রকৃষ্ট নজির দেখতে পাই। একই কাতারে আমির-ফকির; সেখানে মানুষ হিসেবে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। নবীজি তাঁর এক বাণীতে বলেছেন, 'মানুষের প্রতি যে ব্যক্তি দয়া বা অনুগ্রহ প্রদর্শন করে না, মহান আল্লাহ তার প্রতিও করুণা প্রদর্শন করবেন না।' তিনি আরও বলেছেন, 'সমগ্র সৃষ্টিই হচ্ছে মহান আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আর তাই সৃষ্টিকুলের মাঝে সে-ই মহান আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অধিক প্রিয়, যে তার পরিবারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।'
মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর যারা তাঁর সঙ্গে অতীতে চরম দুর্ব্যবহার করেছিল; নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল, তাদের সবার প্রতি তিনি মানবিক আচরণ করেন। চরম দুঃসময়ে, যুদ্ধের ময়দানে এমনকি শত্রুর সঙ্গেও তিনি মানবিক আচরণের ধারা বজায় রেখেছেন। মক্কা বিজয়ের পর এক বৃদ্ধাকে তিনি দেখতে পেলেন ভারী এক বোঝা বহন করে দূর পাহাড়ের দিকে যাচ্ছেন। দয়ার নবী বুড়ির কাছে থেকে বোঝাটি স্বীয় মাথায় উঠিয়ে নিলেন এবং তার গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। বিদায়বেলায় বুড়ি অবাক-বিস্ময়ে মক্কার পাশবিক ও রুগ্‌ণ সমাজে এমন বিনয়ী, পরোপকারী মানুষের সন্ধান পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করে যখন দয়াল নবীর পরিচয় পেলেন, বুড়ি তখন আর চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। চিৎকার করে আর আত্মবিশ্বাসভরে তিনি বলতে লাগলেন- 'এই যদি হয় মুহাম্মদ (সা.)-এর মানবিক চরিত্র, তবে তিনি কোনো মানুষেরই ক্ষতি করতে পারেন না।' আর হ্যাঁ, তিনি কারও ক্ষতি করতে আসেননি। তিনি এসেছেন মানবিকতা, সম্প্রীতি আর পরোপকারিতার মাধ্যমে সর্বোন্নত ও মহত্তম এক মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে; যেখানে তিনি সর্বোতভাবে সফল হয়েছেন।
রাসুলে পাকের উপরোক্ত শিক্ষা অনুযায়ী বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর প্রকৃষ্ট সময় বর্তমানে আমরা অতিবাহিত করছি। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যার কারণে দুর্গত মানুষের ভোগান্তি ও কষ্ট সীমাহীন। এমতাবস্থায় বিপন্ন ও দুর্গত মানবতার পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নৈতিক, ইমানি ও আবশ্যিক দায়িত্ব। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন থেকে শুরু করে নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আর্তমানবতার পাশে দাঁড়িয়েছে। সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে চলেছে। স্রষ্টাকে পেতে হলে আগে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে; সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি রহম করো; আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। বন্যাপীড়িত মানুষের ওপর আসা বিপদ-আপদ ও সমস্যা-সংকুল অবস্থায় আন্তরিক হয়ে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাদের খেদমতে নিয়োজিত হওয়াই এখন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়