দেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে অবাধে কিডনি বাণিজ্য চলছে, তাতে আমরা বিস্মিত। বিশেষ করে জয়পুরহাটে কিডনি বেচাকেনার ভয়ংকর প্রবণতা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সেখানে বংশপরম্পরায় কিডনি বেচাকেনা চলছে। এমনকি ধরা পড়ে জেল খেটে আবার কিডনির দালালি করছেন অনেকে। বৃহস্পতিবারের সমকালে প্রকাশ 'নতুন-পুরোনো দালালে চাঙ্গা কিডনি বাণিজ্য।' প্রতিবেদন অনুসারে, জয়পুরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কিডনি বাণিজ্য ঢাকায় বসে নিয়ন্ত্রণ করছে একটি চক্র। এ চক্র কীভাবে কিডনি চিকিৎসার নামে ধোঁকা দিয়ে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি ব্যবসা করছে; গত বছর সমকালের আরেক প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত আমরা দেখেছি। সেখানে এও বলা হয়েছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ৩১ গ্রামে ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন শতাধিক অভাবী মানুষ তাঁদের একটি করে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। সেখানে একটি পরিবারে বাবার পর ছেলে যেমন এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি আরও অনেকেই দালালির সঙ্গে যুক্ত।
আইন অনুযায়ী মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও কীভাবে প্রকাশ্যে কিডনি কেনাবেচা চলছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত দুই মাসে উল্লেখযোগ্য দালালকে গ্রেপ্তারের পরও থেমে নেই তৎপরতা। আমরা মনে করি, দালালদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এ চক্রের হোতাসহ সংশ্নিষ্টদের ধরে তাদের মূলোৎপাটন করা অসম্ভব নয়। পাশাপাশি সেখানকার মানুষের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। দালালরা যেভাবে অভাবী মানুষদের 'টার্গেট' করে টাকা ধার দেন এবং সেই টাকা দিতে না পারলে কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দেন, সেই ফাঁদ সম্পর্কেও সবাইকে অবহিত করা জরুরি। দালালদের প্ররোচনায় তো বটেই; রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভেও অনেকে তাঁর কিডনি বিক্রি করে থাকেন। এমনকি একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমরা জানি, প্রত্যেকের দেহে দুটি কিডনি থাকে। একটি কিডনি সচল থাকলেও মানুষ বাঁচতে পারে। কেউ স্বেচ্ছায় চাইলে কাউকে একটি কিডনি দান করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে এক ধরনের 'ম্যাচিং' থাকতে হয়। সাধারণত পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই তা বেশি দেখা যায়। কিডনি প্রতিস্থাপনে অন্যকে কিডনি দান করা গেলেও যেভাবে কিডনি নিয়ে বেচাকেনা চলছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেহ থেকে একটি কিডনি বের করে আনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি আইনে কিডনি বিক্রি কিংবা সহায়তায় সর্বোচ্চ ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ সেভাবে আমরা দেখছি না। বলাবাহুল্য, এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই কিডনি ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব।
স্থানীয় লোকজন সমকালের প্রতিবেদককে বলেছেন, প্রশাসনের তৎপরতার কারণেই মাঝে কয়েক বছর কিডনি বেচাকেনা প্রায় বন্ধ ছিল; কিন্তু বছর দুয়েক ধরে ফের এ ব্যবসা জমে উঠেছে। আমরাও মনে করি, প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে গ্রাম পর্যায়ে এভাবে কিডনির ব্যবসা চলতে পারে না। স্বস্তির বিষয়, কালাই থানার প্রশাসন এ ব্যাপারে তৎপর। এরই মধ্যে ওই থানায় প্রায় দেড় ডজন মামলা হয়েছে এবং অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। কালাইয়ের পাশাপাশি জয়পুরহাটের অন্যান্য উপজেলা এবং সারাদেশে যারাই কিডনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
কিডনির বিপজ্জনক কারবার যেন লালনের 'কানার হাটবাজার'। এক সময় দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়ে যাঁরা কিডনি হারিয়েছেন; প্রত্যাশিত মূল্য না পেয়ে ক্ষোভ থেকে কিংবা অর্থের লোভে এখন তাঁরাই আবার দালালি করছেন! আমরা মনে করি, মানবিকতার স্বার্থেও এ অপতৎপরতা বন্ধ হওয়া জরুরি। কিডনি বিক্রির কারণে অনেকেই শারীরিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন এবং চিকিৎসকের নিকট যেতেও ভয় পাচ্ছেন। গরিব মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এমন ব্যবসা কোনোমতে চলতে দেওয়া যায় না।