সৃষ্টি ও স্রষ্টা অবিচ্ছেদ্য। মানবসভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য শিল্পের প্রতিটির সঙ্গে সৃষ্টি ও স্রষ্টা অবিচ্ছেদ্য রয়েছে। এটা এমনিতে হয়নি, করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে যুগের পর যুগ মানুষের স্মৃতিপটে সেসব স্থাপত্য শিল্প অমলিন। ষাটের দশকে স্কুলে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লা, ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গ, পিরামিডসহ বহু স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাস ছিল। ছাত্রছাত্রীদের ওইসব ইতিহাস মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় 'টীকা' লিখতে হতো। যার ফলে সবাই জানে- কে, কবে, কখন, কীভাবে এসব কালোত্তীর্ণ স্থাপত্য শিল্প সৃষ্টি করেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি 'বাংলাদেশ' যেমন গোটা বিশ্বের বিস্ময়, তেমনি তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় 'পদ্মা সেতু' নির্মাণ করে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়ে সক্ষমতার স্মারক স্থাপন করলেন। এই কীর্তি তাঁকে কালজয়ী করে রাখবে। তবে মানুষের স্মৃতি খুবই দুর্বল। তাই 'স্মরণীয়' করে রাখার জন্য যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। স্কুলের ইতিহাস বইয়ে যদি মোগল, পাঠান, ব্রিটিশদের ইতিহাস পড়ানো না হতো, তবে এতদিন ধরে তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লা, ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গ কিংবা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা মানুষ মনে রাখত না। ভুলে যেত, ভুলিয়ে দেওয়া হতো। যেমন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার লোমহর্ষক ইতিহাস। তাই শ্রুতি ও স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই মানুষ স্থাপত্য শিল্প স্থাপন করে, ইতিহাস লিখে রাখে। 

এ দেশে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা ইতিহাস খেয়ে ফেলে, বিকৃত করে। নইলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নিয়ে এত নোংরামি কেন! ইতিহাসের নির্ঘণ্ট- '৪৯, '৫২, '৬২, '৬৬, '৬৯, '৭০ এবং '৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ। এটা কে জানে না। তারপরও কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করে। রাজনীতির বিরোধিতা আর ইতিহাসের বিরোধিতা এক জিনিস নয়। ইতিহাসের বিরোধিতায় জাতির মর্যাদা বাড়ে না, ম্লান হয়। কেউ কেউ আবার বিষবৃক্ষ রুয়ে রাখে, যাতে পরিবর্তিত ভবিষ্যতে ফল পাওয়া যায়। 

শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতু বানিয়েছে। শুরুতে এ নিয়ে এত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ঝামেলা করা না হলে সেতুর ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু যতবেশি জল ঘোলা করা হলো, ততই শেখ হাসিনার পাল্লা ভারী হলো। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। তখনও বিএনপি এবং তাঁদের মিত্ররা কম কটূক্তি করেননি। এখন সেতু দৃশ্যমান। দেশবাসী পদ্মা সেতুর জন্য গর্বিত। সবাই শেখ হাসিনার প্রশংসা করছেন। এতে বিএনপির সমস্যা কোথায়! ভালো না লাগলে মুখে কুলুপ দিয়ে রাখলেই হয়। কেন শুধু শুধু লোক হাসানো। বিএনপির লোকজন কি এসব তামাশা পছন্দ করে। তারা কি এই সেতু দিয়ে যাতায়াত করবে না। বরং রাজনৈতিক কারণে হলেও তাদের বলা উচিত ছিল, কোনোকালে ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা আরিচা পয়েন্টে আরেকটি সেতু বানাবে। অন্যের সাফল্যকে ম্লান করতে গেলে নিজেদের জোকার হতে হয়...।

পদ্মা সেতু বানানোর ক্ষেত্রে মোটাদাগে সবাই বলছেন এবং মনে করেন 'পদ্মা সেতু' যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ এই সেতু সৃষ্টির গল্প এবং এর স্রষ্টাকে মনে রাখবে। এটা সান্ত্বনার কথা। ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষী দেয়। তাই বাংলাদেশের মর্যাদা ও সক্ষমতার স্মারক 'পদ্মা সেতুর' দুই প্রান্তের প্রবেশ মুখে জাতির পিতা বঙ্গবল্পূব্দ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যুরালসহ দৃষ্টিনন্দন তোরণ নির্মাণ করা হলে সৃষ্টি ও স্রষ্টা একই বৃন্তে দৃশ্যমান থাকবে। তোরণের খিলানে সেতু সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাবলি থাকলে লোকজন সেতুর দিকে যেতে যেতে এর আদ্যোপান্ত সব কিছু জানতে পারবে। দুই প্রান্তে একই নকশার সর্বাধুনিক স্থাপত্য শৈলীর তোরণ নির্মাণ করা হলে সেটিও হবে আরেক বিস্ময়। সেতুর প্রবেশ মুখে দৃষ্টিনন্দন বিশাল আকৃতির তোরণে শেখ হাসিনার ম্যুরাল দেখে সবাই বুঝবে, তিনিই এর স্থপতি। এরকম কিছু একটা করা দরকার এ জন্য যে, 'পদ্মা সেতু' শুধু একটি ব্রিজ নয়, একটি ইতিহাস। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা ও দৃঢ়তার স্থাপত্য স্মারক। যুগযুগ ধরে এই স্থাপত্য স্মারকের গল্পকথা স্মরণীয় করে রাখার জন্য দৃষ্টিনন্দন তোরণ নির্মাণ করা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ সর্বস্তরের মানুষ ওই তোরণের সামনে, নিচে বা আশপাশে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রতিদিন শত শত সেলফি তুলে ছড়িয়ে দেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশ্ববাসী দেখবে সক্ষম ও সম্ভাবনার বাংলাদেশকে। 

 ২৫ জুন পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে। উদ্বোধনীর এই বিশাল আয়োজনে যুক্ত থাকবে গোটা দেশ। যুক্ত হবে বিশ্বের সব প্রান্তের বাঙালি, বাংলাদেশি মানুষ। উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখবে বিশ্ববাসী। এই মহোৎসবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমন একটা 'তোরণ' নির্মাণের ঘোষণা করা হলে জাতির কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটবে। মানুষ খুশি হবে। স্বপ্নের 'পদ্মা সেতু' বাস্তবে এক স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একই বৃন্তে দৃশ্যমান করবে।