
লজ্জা। এ লজ্জা আমি রাখব কোথায়? এ লজ্জা আমি ঢাকব কী রূপে! শতবছরের বঞ্চনার শিকার বাঙালি যখন সসম্মানে বিশ্বের বুকে গর্বিত পদচিহ্ন এঁকে চলেছে, তখন আঁধার ঘরের প্রদীপের টিম টিমে আলোয় আমার লজ্জাও আমি দেখতে পাচ্ছি না।
কেমন এক আধিভৌতিক রহস্যময় কুহেলিকার মতো আমার লজ্জা আমি প্রকাশ করতেও লজ্জা পাচ্ছি।
বলছিলাম, আজ বিশ্বের বুকে খেলাধুলায়-স্যাটেলাইটে, মেট্রোরেলে, পদ্মা সেতুতে-জিডিপির গ্রোথে, দেশের উন্নয়নে সারাবিশ্বের বিস্ময় আমি এক রোল মডেল। অথচ আজ আমি পরবাসী নিজ দেশে!
লজ্জা লাগে যখন দেখি 'আসাদের লাল শার্ট', 'স্বাধীনতা', 'ক্রীতদাসের হাসি', 'ফাঁসির মঞ্চে মরতে এসেছি'- এমনই সব পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বিদ্রোহীরা আজ বাংলাদেশে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। বাংলার সংস্কৃতি পরিমণ্ডলের এসব উজ্জ্বল নক্ষত্র মহাশূন্য হতে ঝরে পড়ছে বাংলার আস্তাকুঁড়েতে।
'মেঘনা পারের মেয়ে আমি মেঘনা পারের মেয়ে/ আমি বেড়াই হেসে খেলে ...', 'রানী খালের সাঁকো' এর রচয়িতা কবি আহসান হাবিব, কবি ফররুখ আহমেদ, পল্লিকবি জসীম উদ্দীন আজ সব কালের গর্ভে নিমজ্জিত। পরবর্তী প্রজন্ম কোনো দিনও জানতে পারবে না, 'কবর'-এর মতো নাটক, পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে শ্রদ্ধেয় মুনীর চৌধুরীর রচনা। এরা জানবে না যে কত বইয়ের মলাটের চিত্র এঁকেছেন পটুয়া কামরুল হাসান ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ওরা হয়তো জানবেও না যে চারুকলার প্রতিষ্ঠাতা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। হয়তো কেউ কেউ ৫০ টাকার নোটের ওপর অঙ্কিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবির নিচে ভুল বানানে তাঁর নামটা দেখবে। কিন্তু জানবে না শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবন-সংগ্রামের কথা। উনিশ শ সত্তরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা জলোচ্ছ্বাসের চিত্রের কথা! কারণ যে অন্ধ-বধির সমাজ তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারে, তারা কী করে শ্রদ্ধা করতে শিখবে তার পূর্বসূরিদের!
যে সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কালিমা লিপ্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সচিবদের মতো লোকদের হঠকারিতার পদচিহ্ন দেখি, সে সমাজ কী করে তার পরবর্তী প্রজন্মকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা করা শেখাবে?
আজ সাহিত্যিক আবুল ফজল, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মর্তুজা বশীর উল্লাহ্, আবু জাফর শামসুদ্দিন, যিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপন্যাসের রচয়িতা- তাঁদের সবাইকে ভুলে বসেছে বাংলার পরবর্তী প্রজন্ম। রশীদ করিম, আবু রুশদ মতিনউদ্দিন, আবুল হোসেন ... কত নামের তালিকা বাড়াব!
লজ্জায় মুখ ঢেকে হাঁটতে হয়।
লজ্জায় মুখ ঢেকে হাঁটতেও লজ্জা হয়। কেউ কোথাও কি নেই যে কিনা এই লজ্জার স্থানটা ঢাকার জন্য এগিয়ে আসবে? মায়ের কাছে সন্তানদের এই লজ্জার কথা জানাবে?
আজ কেবল টাকা টাকা আর টাকা, এই টাকা টাকা করে কি তোমার লাভ হচ্ছে?
মাঝে সুইস ব্যাংক মোটা হচ্ছে। এই টাকা তোমায় কী এনে দেবে?
প্রতিনিয়ত অবৈধ উপার্জনের তালিকায় ওসি প্রদীপ, পি কে হালদার, বনের রাজা উসমান কত-শত নাম বের হচ্ছে, কিন্তু কেউ কোথাও লজ্জাও পাচ্ছে না, লজ্জা পায়ও না। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো কেবল টাকা টাকা আর টাকা- এই জীবন চেয়ে ছিলাম বুঝি!
ডাক্তার, চৌকিদার, দফাদার, অধ্যাপক, ড্রাইভার, অফিসার, জমাদার সবের কেবল টাকা চাই টাকা। টাকা দিয়ে তুমি করবেটা কী? যদি তুমি তোমার পিতার কথা ভুলে যাও। ভুলে যাও তোমার পূর্বসূরিদের কথা!
এক্ষণে আমার বড্ড লজ্জা হচ্ছে, সমাজে আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের কী পরিচয় আমি রেখে যাব?
এসব ভুলে যাওয়ার লজ্জার স্থানটা আমি কোন কাফনে ঢাকব?
জাঁ-নেসার ওসমান: লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
বিষয় : অন্যদৃষ্টি জাঁ-নেসার ওসমান
মন্তব্য করুন