- মতামত
- নিরাপদ কর্মক্ষেত্র দূর অস্ত
নিরাপদ কর্মক্ষেত্র দূর অস্ত
দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বাড়ছে। বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির সাম্প্রতিক এক জরিপ সে কথাই বলছে। জরিপের ফল অনুযায়ী, গত ছয় মাসে কর্মক্ষেত্রে ৩৩৩ শ্রমিক নিহত হয়েছেন, গত বছর একই সময়ে যা ছিল ৩০৬। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে চল্লিশের অধিক দুর্ঘটনায় এসব প্রাণহানি ঘটে। ২ শতাধিক কর্মক্ষেত্রের মধ্যে নিহত এ শ্রমিকরা প্রধানত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন পরিবহন খাতে। সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবহন চালক ও শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যাটি একই সঙ্গে দেশের সড়ক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও তুলে ধরেছে। এ ছাড়া ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
সম্প্রতি অগ্নিদুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাগুলো যেভাবে বেড়ে চলেছে তাও হতাশাজনক। কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা এবং কারখানা ভবনে জরুরি বহির্গমন পথ না থাকার বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও অনেক প্রতিষ্ঠানই এ ব্যাপারে নির্বিকার। কখনও কখনও কারখানা নির্মাণে সংশ্নিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতিও নেওয়া হয় না। দাহ্য রাসায়নিক সংরক্ষণে অদক্ষতা ও অবহেলার বিষয়টিও সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির কারণে সামনে এসেছে। কোনো রকম নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই যেভাবে সেখানে অতি দাহ্য পদার্থ রাখা হয়েছে, তার করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে সেখানকার ৪৯ শ্রমিককে। গত ৪ জুন সংঘটিত এ অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে, কী অবহেলায় আমদানি-রপ্তানির জন্যে ব্যবহূত হাজার হাজার কনটেইনার ওই ডিপোতে রাখা হতো। শুধু তা নয়, প্রাথমিক তদন্তে এ-ও জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের ওই বেসরকারি ডিপোতে কোনো কার্যকর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না; কোনোরকম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ্হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো অতি দাহ্য রাসায়নিকের কনটেইনার তৈরি পোশাকের কনটেইনারের সঙ্গে রাখা হতো। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাই প্রথম। দুঃখজনকভাবে শ্রমিকদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে সেই নিরাপত্তাই উপেক্ষিত। প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন অনুযায়ী ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা জরুরি হলেও কিংবা প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলা দরকার হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। ফলে জরিপে এসেছে, বিদ্যুৎস্পর্শে; ছাদ, শক্ত বা ভারী কোনো বস্তুর আঘাত বা তার নিচে চাপা পড়ে; বয়লার বিস্ফোরণ; পানিতে ডুবে এমনকি বজ্রপাতেও শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে।
এদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতা যেমন রয়েছে, তেমনি যথাযথ মজুরি নিশ্চিত না করা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টিও সাধারণ ঘটনা। অথচ আমাদের দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এসব খাতের শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থাও নেই। এমনকি বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শ্রমিকের মানসম্মত মজুরি নির্ধারণ, কর্মঘণ্টা, ছুটি, বিশ্রাম, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং কল্যাণ কার্যক্রমের মতো বিষয় থাকলেও এ আইনের বাইরে রয়ে গেছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। আমরা মনে করি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য একটি আইন করা প্রয়োজন অথবা বিদ্যমান আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এ শ্রমিক অরক্ষিত এবং অধিকার বঞ্চিতই থেকে যাবেন।
আলোচ্য জরিপের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সংশ্নিষ্ট মালিকেরা যেমন শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয়ে উদাসীন তেমনি বিষয়গুলো দেখভালের জন্য যেসব সরকারি সংস্থা আছে তারাও দায়িত্ব পালনে মনোযোগী নয়। ভবন ত্রুটিমুক্ত কিনা, শ্রমিকের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা যথাযথ কিনা কিংবা গ্যাসের সুরক্ষিত ব্যবহার হচ্ছে কিনা ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় নজরদারির জন্য সরকারের আলাদা বিভাগ রয়েছে। শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এসব কর্তৃপক্ষের সমন্বিত তদারকিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, যখনই কোনো শ্রমিক প্রাণ হারান, তৎক্ষণাৎ সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণের ওয়াদা করে মালিকপক্ষ। আমরা মনে করি, ক্ষতিপূরণ যথাযথ হওয়া উচিত এবং কোনো শ্রমিক আহত হলে কিংবা পঙ্গু হয়ে গেলে তাঁর জন্যও ন্যায়সংগত বরাদ্দ থাকা জরুরি। যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে দেশে উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসছে, তাঁদের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে।
মন্তব্য করুন