
শ্রীলঙ্কায় ৩০ বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলেছিল, সেই যুদ্ধে তামিল টাইগারদের হারানোর পর অনেকে মনে করেছিলেন শ্রীলঙ্কার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই জায়গায় কয়েকটি বিষয় দেখার প্রয়োজন ছিল। একটি হলো- ৩০ বছর যুদ্ধ হওয়ার কারণে দেখা গেছে, শ্রীলঙ্কার এলিট শ্রেণির অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। তামিল এলিটরা তো কখনও ফিরেই আসেননি।
যেহেতু এটি ছিল একটি গৃহযুদ্ধ এবং এতে সিংহলি গোষ্ঠীদের জয় এবং তামিলদের বড় ধরনের পরাজয় হয়েছিল, এ কারণে তামিল এলিটরা আগে থেকেই চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে ৩০ বছর যুদ্ধের কারণে সিংহলি এলিটরাও চলে গিয়েছিলেন। এলিটরা কখনও শ্রীলঙ্কায় ভরসা রাখতে পারেননি।
তবে যুদ্ধ শেষে অনেকেই ফেরত আসা শুরু করেন। কিন্তু দেখা গেল, ১০ বছর পরই দেশটির ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে আক্রমণ হলো। তখন এর প্রভাভ পড়ল দেশটির পর্যটন শিল্প ও ক্রীড়া খাতে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হোটেলগুলোয় আক্রমণের ফলে এই খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেন এসব হোটেলে আক্রমণ হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণা হয়নি।
আক্রমণের কারণে বিদেশি পর্যটকরা আসা বন্ধ করলেন। এরপরই এলো করোনা অতিমারি। করোনা আসার পর দেশটির পর্যটন শিল্পের আয় শূন্যের কোঠায় চলে যায়। এ ছাড়া এলিটরা দেশের ওপর ভরসা তো রাখেনইনি, বরং তাঁদের সঙ্গে দেশটির সাধারণ মানুষের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এর বহিঃপ্রকাশ দেখলাম প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী অথবা মন্ত্রীদের ওপর জনগণের হামলায়। এসব এলিট এবং সাধারণ মানুষের লাইফস্টাইলে বিশাল পার্থক্য হয়ে যাচ্ছিল। এলিটদের সন্তানরা বিদেশেই থাকে, সেখানেই পড়াশোনা করে। সব মিলিয়ে জনগণের ক্ষোভটা বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে সেই ক্ষোভের উদ্গিরণ হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যে রাজাপাকসে যুদ্ধের নায়ক ছিলেন, সেই রাজাপাকসেই বলতে গেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমার মনে হয়, এ সময় শ্রীলঙ্কায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বাড়তে থাকবে। কেননা রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাতে জনগণের আক্রোশ থামেনি। এ ক্ষেত্রে দেশটি দুই রাজনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দিকে যেতে পারে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীকেও ভূমিকা রাখতে হতে পারে। তবে দেশটির অর্থনীতির কাঠামো ঠিক করতে, বিশেষ করে দুর্নীতি দমনে বড় একটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দেশটি সেটি করতে পারবে কিনা সেটা দেখার বিষয়। আপাতত মনে হচ্ছে, দেশটি জাতীয় সরকারের দিকে যাবে, যদিও তাঁরা নির্বাচনের কথা বলছেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক করতে হলে রাজনৈতিক কাঠামো ঠিক করতে হবে। দেশটির আইএমএফের সাহায্য প্রয়োজন। সেই আইএমএফই বলছে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক কাঠামো ঠিক করার কথা। যদি জাতীয় সরকার গঠন করা হয় তাহলে সেটি সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। আর তা না হলে সামরিক বাহিনী ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক কাঠামো ঠিক করতে পারে। তাহলে হয়তো অর্থনৈতিক কাঠামো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হবে।
রাজাপাকসের ওপর অনেক দেশই অসন্তুষ্ট। কেননা তিনি পরিবারকে ঘিরে ক্ষমতায় ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন। তিনি প্রচণ্ড অহংকারী হয়ে গিয়েছিলেন। তার ওপর আবার দূর্নীতির বিষয়টা তো ছিলই। সব মিলিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল এমনটা বলা মুশকিল। এখন দেখার বিষয়, দেশটির রাজনীতিবিদরা বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কীভাবে আইনের শাসন বাস্তবায়ন করেন। দেশটির অর্থনীতি এক প্রকার ভেঙেই পড়েছে। এটাকে সামাল দেওয়া এবং এমন একটা কাঠামো তৈরি করা যাতে, পশ্চিমা দেশগুলো আবারও সহায়তা দেবে- সেটি পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, রাজাপাকসের সমর্থক এখন অনেকটাই কমে গেছে। তিনি হয়তো আপাতত মালদ্বীপে আছেন, কিন্তু সেখানে তিনি কয়েক দিন থাকতে পারবেন, এরপর কোন দেশে যাবেন সেটা পরিস্কার নয়। যদিও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেকেরই হয়তো আমেরিকার পাসপোর্ট আছে, তাঁদের হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে। রাজাপাকসের ব্যক্তিগতভাবে অন্য দেশের পাসপোর্ট আছে কিনা, সেটি আমার জানা নেই। সেটি গেল একটা বিষয়। বড় বিষয়টা হলো যে, রাজাপাকসে বিদায় হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সেটা তো নয়। দেশটি যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে সেটিও সামাল দিতে হবে। কোন রাজনীতিবিদরা সামাল দেবে, জনগণ কতটা ত্যাগ স্বীকার করবে সেই দিকটা পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি কোন দিকে যাবে সেটা বোঝা মুশকিল।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আপাত দৃষ্টিতে সেটাই মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে 'স্টেট অব ইমার্জেন্সি' দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে স্বাভাবিকভাবেই সামরিক আইন জারি হবে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসবে কিনা সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ, ক্ষমতায় এলেই যে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে এমনটা, সেই ঝুঁকিই বা সামরিক বাহিনী কেন নেবে? তারা চাইবে রাজনীতিবিদরাই এটা করুক। সামরিক বাহিনী হয়তো পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করবে, সহজে হয়তো সামনে আসবে না। সর্বোপরি, যেই-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তার চ্যালেঞ্জ হবে বিশাল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন