
শৌলাগড় হাওর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলাধীন বিশাল আয়তনের সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃষ্টিনন্দন হাওর। জনশ্রুতি, এই হাওরে এক সময় প্রচুর পরিমাণে শোল মাছ পাওয়া যেত। এই শোল থেকে শৌলা আর বন এলাকার গড় মিলে নাম হয়েছে শৌলাগড়। কাগজে-কলমে এই হাওরের বড় একটি মৌজার নাম গড়শৌলা। শৌলাগড় হাওরের উত্তরাংশে নবীগঞ্জের ১ নম্বর বড়ভাকৈর পশ্চিম ইউনিয়ন ও ২ নম্বর বড়ভাকৈর পূর্ব ইউনিয়নের জনপদ এবং এলজিইডি সড়ক, পূর্বে গুমগুমিয়া, ভাকৈর ও অন্যান্য গ্রাম, দক্ষিণে দুর্গাপুরের পার্শ্ববর্তী এলজিইডি সড়ক, দক্ষিণ-পশ্চিমে হাওয়া নদী এবং পশ্চিমে কাচিহাতা, পালকিভাঙা।
শৌলাগড় হাওরের মাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রাকৃতিক উর্বর জৈব সারসমৃদ্ধ। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্রিম সার প্রয়োগ করতে হয় না। নবীগঞ্জবাসীর প্রাণভোমরা শৌলাগড় হাওরে সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় আগাম বন্যা হলে ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। দেশি নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছের বিশাল ভান্ডার এটি। বড় মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, ঘনিয়া, বোয়াল, আইড়, বাঘাইড়, কালিবাউশ, ফলি, চিতল, শোল, গজার, বড় বাইন, কুচিয়া, বামোশ ইত্যাদি; ছোট মাছের মধ্যে মলা, কাচকি, পুঁটি, টেংরা, টাকি, চেঙ, রানি, কই, খলিশা, চান্দা, গুতুমসহ বাংলাদেশে প্রাপ্ত মিঠাপানির ২৫১ প্রজাতির প্রায় অর্ধেক প্রজাতির মাছ এখানে পাওয়া যায়। হাওরের মাছের স্বাদ যে অতুলনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সময় নবীগঞ্জ অঞ্চল কই মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন হাওরে বেশ বড় আকারের কই মাছ পাওয়া যেত।
এ অঞ্চলের জনগণের বেশিরভাগ এখনও ধান ও মাছের ওপর নির্ভরশীল। হাওর জনপদে জমি দু'ফসলি। হাওরের নিচু অংশে শুধু বোরো মৌসুমের ধান চাষ হয়, যা বৈশাখ মাসে তোলা হয়। আর উঁচু অংশ ও অন্যান্য উঁচু জমিতে আমন মৌসুমের ধান চাষ হয়, যা অগ্রহায়ণ মাসে তোলা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগাম বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা নিদারুণ কষ্টে আছে।
মৎস্যজীবীরা ভরা বর্ষায় স্বাধীনভাবে মাছ ধরলেও বর্ষা শেষ না হতেই একদিকে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য, অন্যদিকে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। প্রভাবশালীরা স্থানে স্থানে স্থায়ীভাবে জাল গেড়ে বসে থাকে। বরুণ, হিজল, করচ, মান্দার ইত্যাদি গাছ হাওরে বেশ ভালোই ছিল। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষক কাইট্যা-কাছিম এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও এখন কালেভদ্রে দেখা যায়।
শৌলাগড় হাওরের সঙ্গে উত্তরে বিবিয়ানা নদী, দক্ষিণে হাওয়া নদীর সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে অনেক খালের মাধ্যমে। শৌলাগড় হাওর ও বিবিয়ানা নদী সংযোগকারী খালগুলো হচ্ছে- কাঁকড়াখালি (কাজীরগাঁও-আগনা), করোতা (বাগাউড়া-কাজির বাজার), কামরাখাই খাল, রামপুর খাল, শৈলা খাল, হলিমপুরের মাঝের খাল, চরগাঁও খাল, সোনাপুরের পশ্চিমের খাল, জগন্নাথপুরের মাঝের খাল, আমড়াখাইর ও বাউসীর মাঝের খাল, চৌকির পশ্চিমের খাল। হাওরের পরিবেশ রক্ষা এবং উপজেলায় জনগণের যোগাযোগের জন্য হাওরের মাঝখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রয়োজন। ফ্লাইওভারের দু'দিকের সড়ক হবে আবুরা। ছোট সেতু নির্মাণ করা যাবে না। কারণ, ৩০ থেকে ৫০ ভাগ জায়গা পানি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত না থাকলে হাওরের জলজ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পানির অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে জলজ প্রাণী, বিশেষ করে মাছের চলাচল, বংশবিস্তার ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে হাওর পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সর্বোপরি, সম্ভাবনাময় শৌলাগড় হাওর বাঁচাতে 'শৌলাগড় হাওর উন্নয়ন প্রকল্প'তে জরুরি ভিত্তিতে সীমানা এলাকা ঘোষণা প্রয়োজন। অকাল বন্যা থেকে ফসল রক্ষায় শুকনো মৌসুমেই হাওর সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও জলাবদ্ধতার কবল থেকে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। তা ছাড়া হাওর-নদীর সংযোগকারী অভ্যন্তরীণ খালগুলো পুনর্খনন, কম সময়ে উৎপাদনশীল উদ্ভাবিত জাতের ধান রোপণে কৃষকদের প্রণোদনা প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ।
শৌলাগড় হাওর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অকাল বন্যা কিংবা অস্বাভাবিক বন্যার কবল থেকে ফসল ও জনপদ রক্ষা পাবে; কৃষি-অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; মাছের উৎপাদন বাড়বে ও আমিষের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে। এতে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে।
সনজিৎ নারায়ণ চৌধুরী: শিক্ষক ও গবেষক
শৌলাগড় হাওরের মাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রাকৃতিক উর্বর জৈব সারসমৃদ্ধ। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্রিম সার প্রয়োগ করতে হয় না। নবীগঞ্জবাসীর প্রাণভোমরা শৌলাগড় হাওরে সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় আগাম বন্যা হলে ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। দেশি নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছের বিশাল ভান্ডার এটি। বড় মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, ঘনিয়া, বোয়াল, আইড়, বাঘাইড়, কালিবাউশ, ফলি, চিতল, শোল, গজার, বড় বাইন, কুচিয়া, বামোশ ইত্যাদি; ছোট মাছের মধ্যে মলা, কাচকি, পুঁটি, টেংরা, টাকি, চেঙ, রানি, কই, খলিশা, চান্দা, গুতুমসহ বাংলাদেশে প্রাপ্ত মিঠাপানির ২৫১ প্রজাতির প্রায় অর্ধেক প্রজাতির মাছ এখানে পাওয়া যায়। হাওরের মাছের স্বাদ যে অতুলনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সময় নবীগঞ্জ অঞ্চল কই মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন হাওরে বেশ বড় আকারের কই মাছ পাওয়া যেত।
এ অঞ্চলের জনগণের বেশিরভাগ এখনও ধান ও মাছের ওপর নির্ভরশীল। হাওর জনপদে জমি দু'ফসলি। হাওরের নিচু অংশে শুধু বোরো মৌসুমের ধান চাষ হয়, যা বৈশাখ মাসে তোলা হয়। আর উঁচু অংশ ও অন্যান্য উঁচু জমিতে আমন মৌসুমের ধান চাষ হয়, যা অগ্রহায়ণ মাসে তোলা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগাম বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা নিদারুণ কষ্টে আছে।
মৎস্যজীবীরা ভরা বর্ষায় স্বাধীনভাবে মাছ ধরলেও বর্ষা শেষ না হতেই একদিকে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য, অন্যদিকে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। প্রভাবশালীরা স্থানে স্থানে স্থায়ীভাবে জাল গেড়ে বসে থাকে। বরুণ, হিজল, করচ, মান্দার ইত্যাদি গাছ হাওরে বেশ ভালোই ছিল। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষক কাইট্যা-কাছিম এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও এখন কালেভদ্রে দেখা যায়।
শৌলাগড় হাওরের সঙ্গে উত্তরে বিবিয়ানা নদী, দক্ষিণে হাওয়া নদীর সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে অনেক খালের মাধ্যমে। শৌলাগড় হাওর ও বিবিয়ানা নদী সংযোগকারী খালগুলো হচ্ছে- কাঁকড়াখালি (কাজীরগাঁও-আগনা), করোতা (বাগাউড়া-কাজির বাজার), কামরাখাই খাল, রামপুর খাল, শৈলা খাল, হলিমপুরের মাঝের খাল, চরগাঁও খাল, সোনাপুরের পশ্চিমের খাল, জগন্নাথপুরের মাঝের খাল, আমড়াখাইর ও বাউসীর মাঝের খাল, চৌকির পশ্চিমের খাল। হাওরের পরিবেশ রক্ষা এবং উপজেলায় জনগণের যোগাযোগের জন্য হাওরের মাঝখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রয়োজন। ফ্লাইওভারের দু'দিকের সড়ক হবে আবুরা। ছোট সেতু নির্মাণ করা যাবে না। কারণ, ৩০ থেকে ৫০ ভাগ জায়গা পানি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত না থাকলে হাওরের জলজ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পানির অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে জলজ প্রাণী, বিশেষ করে মাছের চলাচল, বংশবিস্তার ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে হাওর পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সর্বোপরি, সম্ভাবনাময় শৌলাগড় হাওর বাঁচাতে 'শৌলাগড় হাওর উন্নয়ন প্রকল্প'তে জরুরি ভিত্তিতে সীমানা এলাকা ঘোষণা প্রয়োজন। অকাল বন্যা থেকে ফসল রক্ষায় শুকনো মৌসুমেই হাওর সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও জলাবদ্ধতার কবল থেকে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। তা ছাড়া হাওর-নদীর সংযোগকারী অভ্যন্তরীণ খালগুলো পুনর্খনন, কম সময়ে উৎপাদনশীল উদ্ভাবিত জাতের ধান রোপণে কৃষকদের প্রণোদনা প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ।
শৌলাগড় হাওর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অকাল বন্যা কিংবা অস্বাভাবিক বন্যার কবল থেকে ফসল ও জনপদ রক্ষা পাবে; কৃষি-অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; মাছের উৎপাদন বাড়বে ও আমিষের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে। এতে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে।
সনজিৎ নারায়ণ চৌধুরী: শিক্ষক ও গবেষক
মন্তব্য করুন