
শ্রীলঙ্কায় গত কয়েক দিনের ঘটনা নতুন মাত্রা দিয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কার যে উত্থান আমরা দেখছিলাম, সে তুলনায় এ অবস্থা একেবারে বেমানান। সেখানকার নাগরিকদের একটি অংশ যেভাবে গণবিক্ষোভের ছত্রছায়ায় তুলকালাম কাণ্ড করেছে; শতভাগ শিক্ষিত শ্রীলঙ্কায় এমনটি অপ্রত্যাশিত। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, 'শ্রীলঙ্কার সংকট বেশ গভীর। বেশ কয়েক বছর ধরে এই সংকট তৈরি হয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কাকে নিজেদেরই এ সংকট কাটাতে হবে। আমরা তাদের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ও সমর্থক। কিন্তু সংকট থেকে বের হওয়ার পথ ওদেরই বের করতে হবে।' ভারত ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে এবং দেশটির ওপর নজর রাখছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারত চাইছে শ্রীলঙ্কা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করুক।
এদিকে শ্রীলঙ্কার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের নাম সামনে এসেছে। এর মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের নাম আছে। শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা-এসএলপিপির এমপি ডালেস আলাহাপেরুমা এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা সাজিদ প্রেমাদাসাও রয়েছেন এ দৌড়ে। এ বিষয়ে দেশটির সংসদে ২০ জুলাই ভোট হবে। এসএলপিপির একটি অংশের সমর্থন রয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহের প্রতি। অন্য অংশের সমর্থন আছে ডালেস আলাহাপেরুমার প্রতি। এর আগে রাজনৈতিক দল এসজেবি তাদের প্রার্থী হিসেবে সাজিদ প্রেমাদাসার নাম ঘোষণা করেছে। যে প্রার্থী অর্ধেকের বেশি ভোট পাবেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন। ইতোমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির সংসদের স্পিকার। সেখানে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এমনটি ভাবার কারণ নেই। মনে রাখতে হবে, শ্রীলঙ্কার সমস্যা দুটি- একটি রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক। যদিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে না। বস্তুত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হলে অর্থনৈতিক সমাধানও কঠিন কিছু হবে না।
শ্রীলঙ্কার জনগণের একটি অংশের মধ্যে যে অসহিষুষ্ণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাও কম উদ্বেগজনক নয়। সন্দেহ নেই, সেখানে জ্বালানি সংকট তুঙ্গে উঠেছে। এ সমস্যার সমাধান যে রাতারাতি হবে, তা কিন্তু নয়। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকারকে সময় এবং সুযোগ দেওয়া চাই। তা না করে যেভাবে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলো; যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর বাসভবনে হামলা চালানো হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা দেখেছি, পৃথিবীর অনেক দেশই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যের সংকটের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। আর্জেন্টিনা, গ্রিসসহ অনেক দেশই তাদের সংকট কাটিয়ে উঠেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ২০০৮-২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীতে এত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কানদের একটি অংশ যেভাবে অতি উত্তেজিত আচরণ করছে, তা চিন্তার বিষয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শ্রীলঙ্কার অবস্থা স্বাভাবিকভাবে হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও পড়েছে দেশটির ওপর। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝিও রয়েছে। শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। কারণ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেই বললেই চলে। বৈদেশিক ঋণের বোঝায় শ্রীলঙ্কা জর্জরিত। শ্রীলঙ্কার ঋণ তার জিডিপির চেয়েও বেশি। শ্রীলঙ্কার ঋণের ৪৭ শতাংশ এসেছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার ও বিভিন্ন উৎস থেকে। তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণ এডিবির কাছে, ১৩ শতাংশ। চীন ও জাপান উভয়ের কাছে ঋণ ১০ শতাংশ করে। বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ ৯ শতাংশ। ভারত ও অন্যদের কাছে বাকি ঋণ।
সুতরাং, এককভাবে কোনো দেশের কারণে যে শ্রীলঙ্কার এ দুর্দশা- এমনটি ভাবার কারণ নেই। তাদের বিপুল ঋণ রয়েছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে। অনেক ক্ষেত্রে চওড়া সুদের ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা তা পরিশোধ করতে পারেনি। তবে এটা সত্য, শ্রীলঙ্কা যখন বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত তখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল, তারা সেভাবে এগিয়ে আসেনি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের নৈকট্য আমরা দেখেছি। তারা চীনের সহায়তায় হাম্বানটোটা বন্দরসহ উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরও শ্রীলঙ্কায় ছিল। তারাও পাশে দাঁড়ায়নি। বিশ্বমোড়লদের আচরণে মনে হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সংকট আরও প্রলম্বিত ও ঘনীভূত হওয়ার জন্য তারা সময় ক্ষেপণ করেছে। শ্রীলঙ্কা এমন কোনো বড় অর্থনীতির দেশ নয় কিংবা তাদের ঋণের পরিমাণ এত বেশি হয়ে যায়নি যে, দেশটিকে উদ্ধার করা কঠিন ছিল।
শ্রীলঙ্কার সংকট ত্বরান্বিত করেছে ক্ষমতাসীন সরকারের কিছু ভুল নীতি। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, সেখানে ঋণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নেই এবং দেশটি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সে বাণী আমলে নেয়নি। কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায়ও সেখানকার সরকার সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়নি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায়ও শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। করোনা মহামারির সময় তারা ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে একের পর এক লকডাউন দিয়েছে। ফলে সেখানকার অর্থনৈতিক আয়ের অন্যতম খাত পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চা শিল্পও। নিজেদের সামর্থ্য অগ্রাহ্য করে সরকার ব্যাপকভাবে কর হ্রাস করায় তার প্রভাবও নেতিবাচকভাবে পড়েছে অর্থনীতির ওপর। কৃষিকে শক্তিশালী না করে ভুল কৃষিনীতি গ্রহণ করার প্রভাবও সেখানে দেখা গেছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই শ্রীলঙ্কার সংকট ত্বরান্বিত হয়।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক জোট হয়ে দেশটিকে সাহায্য করা দরকার। তবে বহির্বিশ্বের সহায়তা পেতে হলেও শ্রীলঙ্কাকে আগে ভেতর থেকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। অস্থিতিশীলতা দূর করে একটি স্বস্তির পরিবেশ ফেরাতেও নজর বেশি প্রয়োজন। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে এখনও গোটাবায়া সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সেখানে কীভাবে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়, সেটাই দেখার বিষয়। রাজনৈতিক সমাধান না হলে কেউ ঋণ দেবে বলে মনে হয় না। তাতে অর্থনৈতিক সমাধানও হবে সুদূরপরাহত।
শ্রীলঙ্কার প্রতিবেশী হিসেবে ভারত এগিয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করা নিয়ে ভারতের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও সেখানকার অনেকেই মনে করছেন, তাদের সহায়তা দেওয়া দরকার। সেভাবে ভারত শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে। যদিও তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। চীন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। চীনেরও উচিত এ দুঃসময়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ানো। চীনসহ বৃহৎ শক্তিগুলো শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ালে সংকট স্থায়ী হতে পারে না। আমরা চাই শ্রীলঙ্কার ভেতরেও সে পরিবেশ তৈরি হোক। সংকট সমাধানে সব পক্ষের ইতিবাচক ও আন্তরিকতার বিকল্প নেই।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন