রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের এক প্রসূতির বাবা ফোন করে উৎকণ্ঠার স্বরে বলছিলেন, 'যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার মেয়েকে বাঁচাতে চাই।' উপজেলা হাসপাতাল তাঁকে ডেলিভারি করাতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে এবং অতি দ্রুত জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ন্ত্রিত ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করলাম। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো, রৌমারী থেকে জেলা সদরে যেতে ভাড়া লাগবে ছয় হাজার টাকা। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার একজন রোগীকে শুধু নদী পার হতে যদি ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়, তাহলে সে চিকিৎসা করাবে কী দিয়ে! কথা হলো নদীতীরবর্তী স্কুলের এক শিক্ষক আবু বকর ছিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি বললেন, যাত্রীবাহী নৌকাযোগে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে যাচ্ছিলেন এক প্রসূতি। সেই নৌকায় তিনিও ছিলেন। নৌকা চলার কিছুক্ষণ পর প্রসূতির সঙ্গে যাওয়া লোকজন যাত্রীদের এক পাশে সরে বসতে বলেন। শাড়ি দিয়ে প্রসূতিকে আড়াল করা হলো। কিছুক্ষণ পর একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করল।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অপারগতা প্রকাশ করায় প্রতিনিয়ত রৌমারীসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে যেসব প্রসূতিকে কুড়িগ্রাম জেলা সদরে পাড়ি দিতে হয়, তাঁদের পথিমধ্যে সন্তান প্রসব ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অহরহ। চরাঞ্চলের মানুষের এ সংকট নিত্যদিনের। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, রাজিবপুর উপজেলা দুটি জেলা সদর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন এ দুটি উপজেলা ছাড়াও কুড়িগ্রামে এ রকম বহু দুর্গম চর রয়েছে। এসব চরাঞ্চল বরাবরই অভাবী জনপদ। চরবাসীর জীবন মানেই সংকটময় এক দুরূহ জীবন। চরাঞ্চল উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এখানে ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনে কৃষিজমি, ফসল, গবাদি পশু, ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারানো তাদের ফি বছরের দুঃখগাথা। তাই মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদতীরবর্তী জনগোষ্ঠীকে।

এসব চরাঞ্চলে একটি বিশেষ ঘটনা হলো, বন্যায় এখানকার মানুষ অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে হারায় তার বসতি। যেখানে বন্যা শেষেও তারা নিজ ভিটেয় ফিরতে পারে না। বন্যাকালে রাস্তার ধারে খোলা জায়গায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করে। বন্যাক্রান্ত ও ভাঙনকবলিত বসতিহারা এসব মানুষের পক্ষে ফি বছর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না বলেই কুড়িগ্রাম জেলার অবস্থান দারিদ্র্যের চরম সীমায়। এ বছরও এক দফা বন্যা হয়ে গেল। বন্যার সময় সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে লোকজনের ত্রাণকার্য পরিলক্ষিত হয়। ঝিনুক দিয়ে সাগর সেচার মতো হলেও এ সহায়তা বন্যার্তদের কিছু অংশের জন্য ক্ষণিকের স্বস্তি মিলায়। কিন্তু বন্যাপরবর্তী যাদের খানিকটা ভিটেমাটি টিকে থাকে; আশ্রিত এসব মানুষ ভিটেয় ফেরার পর তাদের না থাকে কাজ, না থাকে ঘরে খাবার। ফলে কমবেশি সব পরিবারকেই খাদ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক পরিবারকেই এক বেলা বা দু'বেলা খাওয়ার পথ বেছে নিতে হয়। তাই বন্যাপরবর্তী সংকট আরও তীব্র।

চরাঞ্চলের মানুষের জন্য বন্যা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই করে না; স্বাস্থ্যসেবারও দারুণ সংকট তৈরি করে। বন্যার সময় চারদিকে থৈ থৈ পানিতে তলিয়ে যায় টিউবওয়েল ও টয়লেট। স্যানিটেশন ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটে। বানের পানিতেই প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হয় অধিকাংশ মানুষকে। আবার এই পানিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। ফলে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, চর্মরোগ, চোখের অসুখ প্রভৃতি সমস্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা, শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিরামহীন বর্ষণ, ঘরের মধ্যে পানি, মধ্যরাতে প্রসূতির প্রসব বেদনার কাতরতা, শিশুর ডায়রিয়া, বৃদ্ধার শ্বাসকষ্টে ত্রাহি অবস্থা। অথচ ডাক্তারের জন্য উপজেলা বা জেলায় যোগাযোগ দুরূহ ব্যাপার। একদিকে নদীপথ, সেখানে নেই নৌকার নিশ্চয়তা- বিষয়টি ভাবা যায়! এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি ঘটলে তা মোকাবিলা করা কতটুকু সম্ভব?

বন্যার কথা বাদ দিলেও স্বাভাবিক সময়ে নদীতীরবর্তী জনগোষ্ঠী বা চরাঞ্চলের মানুষ সারাবছর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বসবাস করে। এ থেকে পরিত্রাণে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সযোগে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মেনে নিতে তারা বাধ্য। আমার জানামতে, শুধু যাত্রীবাহী নৌকায় যাওয়ার সময় কত প্রসূতি প্রসব বেদনায় ছটফট ও মৃত বাচ্চা প্রসব করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এসব মা ভীষণভাবে দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। বন্যাপরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত বাসস্থান মেরামত, অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা, তার ওপর চিকিৎসাসেবার অব্যবস্থাপনা চরবাসীর কাছে যেন বোঝার ওপর শাকের আঁটি। এ জনপদের মানুষের এ এক যুদ্ধ-জীবন। এ যুদ্ধের যেন শেষ নেই। যাদের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়, তাদের চিকিৎসার জন্য অর্থসংস্থান দুঃসাধ্য। সরকারের স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ হিসেবে চরের ইউনিয়নগুলোতে কমিউিনিটি ক্লিনিক এবং কিছু ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে সৃদৃশ্য ভবনে। কিন্তু তাতে না মেলে ডাক্তার, না মেলে ওষুধ। যেখানে ডেলিভারির মতো জরুরি সেবা দেওয়ার আয়োজন থাকা উচিত সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবাই মিলছে না। তাই প্রয়োজন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তত ডেলিভারির মতো জরুরি সেবার জন্য আধুনিক আয়োজনসহ প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ। আবার যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন এলাকা থেকে একজন ইমার্জেন্সি রোগীকে জেলা সদর হাসপাতালে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ফ্রি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, নদীভাঙন প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে চরবাসীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সে হিসেবে চরবাসীর দোরগোড়ায় সেবা পাওয়ার দাবি ন্যায়সংগত।

মহিউদ্দিন মহির: সমাজকর্মী