
এক বুক বেদনা নিয়ে মানিকখালী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাবা। আগের দিন শিশুকন্যাকে দাফন করে মানসিকভাবে তিনি মুষড়ে পড়েছেন। তাঁর চেহারায় আগাগোড়া বিষণ্ণতার ছাপ। তিনি খুঁজছেন, আপন বা পরিচিতজনের মধ্যে আজ ঢাকাগামী কোনো যাত্রী আছেন কিনা। আজকের মধ্যে পুত্রের কাছে কন্যার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাতে হবে। চিঠিপত্র লেখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আজকের চিঠি কবে গিয়ে পৌঁছবে, বলা যায় না। তাঁর ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুহসীন হলে বসবাস। দুঃসংবাদ হলেও এটা তাকে জানাতেই হবে। ট্রেন আসার একটু আগেই তিনি পেয়ে যান তাঁর একজন সুহৃদ ও পুত্রের শুভাকাঙ্ক্ষী শিক্ষককে। তিনি ঢাকার যাত্রী। স্কুলের প্রয়োজনে ঢাকায় বোর্ড অফিসে যাচ্ছেন। আমাদের স্কুলজীবনের খ্যাতিমান সেই প্রধান শিক্ষক সেদিন এ দায়িত্ব সযত্নে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
২. ১৯৮৩ সালের অক্টোবর বা নভেম্বর মাস হবে। ক্যাম্পাসের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার পর মুহসীন হলের সামনে এসে হাজির হই। দেশব্যাপী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে।
প্রতিটা হলের গেটের ওপর ছাত্রদের জটলা। কিছুদিন আগে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন হল ও পুরান ঢাকার নানা স্থান থেকে ছাত্রনেতাদের আনাগোনায় পুরো এলাকা মুখর। হলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ পেছন থেকে আমার ডাকনাম ধরে ভারিক্কি কণ্ঠের এক আদুরে সম্বোধন শুনি। এই ... এদিকে আয়, আমি মাথা ঘুরিয়ে বিস্মিত হই। শান্তু স্যার যে! স্যার, আপনি কেমন আছেন? কোথায় আসছেন? আমি কদমবুসি করতে আভূমি নত হই। স্যার বললেন, তোর কাছেই এসেছি। স্যারের হাতে একখানা ছোট ব্যাগ। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, শান্তু স্যার (শাহ্ শামসুদ্দীন) নিজেই এসেছেন! আমাদের এলাকায় শান্তু স্যার নামেই তিনি প্রায় কিংবদন্তি। স্কুলে যাঁকে দেখলে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতাম, সেই প্রবল ব্যক্তিত্ববান স্যার হলের সামনে বেঞ্চের ওপর বসে আছেন! স্যার আবার বললেন, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ এখানে বসে আছি। সবার দিকে তাকাচ্ছিলাম। তোকে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছি। ছয়তলায় গিয়ে দেখি, তোর রুমে তালা। শোন, একটা দুঃসংবাদ আছে। মন খারাপ করিস না কিন্তু। গতকাল তোর সবচেয়ে ছোট বোন আনোয়ারা মারা গেছে। কটিয়াদী উপজেলা হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়েছে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা হলো। আমার মাথাড চক্কর দিয়ে ওঠে। হতভম্ব হয়ে আমি শুধু একটা প্রশ্ন করি, ওর কী হয়েছিল স্যার? আমি তো ১৫ দিন আগে তাকে ভালোই দেখে এসেছি।
তোর বাবা আমাকে বলেছেন, ধনুষ্টংকার হয়েছিল। কিছুদিন আগে পায়ে কাঁটা বিঁধেছিল। কেউ নাকি কিছু বুঝতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কী করা যাবে, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা। যা, তুই বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে আমার দু'চোখ ভরে জল নেমে আসে। হতবিহ্বল হয়ে যাই। আমার বয়স তখন ২১ হবে। তবু শরীরটা অবশ হয়ে আসছিল। তবে তাৎক্ষণিক সম্বিৎ ফিরে পাই। স্যারকে বিদায় জানিয়ে আমি দৌড়ে নিজের কক্ষে যাই। মনে পড়ে, সেদিন স্যারকে জিজ্ঞেসও করতে পারিনি, তিনি কোথায় উঠবেন, কার সঙ্গে থাকবেন ইত্যাদি। কালবিলম্ব না করে ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসি। তখনও রুমে না ফেরায় রুমমেটকে বলা হয়নি। রাতেই সোজা কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছি। স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে জানতে পারি, আজকের মতো চট্টগ্রামগামী দু'একটা ট্রেন আছে। তবে একটি ট্রেন ভৈরব বাজার ধরবে। অন্যটি ননস্টপ ও দ্রুতগামী। আমি ভৈরব বাজার পর্যন্তই যেতে চাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন প্রস্তুত হলো এবং আমি তাতে চড়ে বসি।
৩. ট্রেনে বসে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। আমার দু'চোখের আয়নায় ছোট বোনটার অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা নিরন্তর নেচে যাচ্ছিল। আহা! কী চটপটে, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ছিল তার! আমি কিছুতেই তাকে একটা মৃত মুখের সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না। ট্রেনটা সেদিন কী অদ্ভুত এবং এক ধরনের বিকট শব্দ করে চলেছিল, ভাবা যায় না। আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, বাঁশবাগান সবকিছু পেছনে ফেলে দানবের মতো ধাবমান ছিল এ মেইল ট্রেন। আমি অন্ধকারে জানালার শার্সিতে চোখ মেলে ধরি- ছোট বোনটার মৃত্যুর কথা ভুলে যাওয়ার শত চেষ্টা করেও পারিনি। ঘুরেফিরে চোখে ভাসছিল, কানে বাজছিল তার শেষ বাক্যটি- ভাইজান, যাইও না; মা তোমাকে খুঁজতেছে...।
এই তো মাত্র ক'দিন আগের কথা। বাড়ি থেকে ঢাকা আসার সময় মাকে সালাম করে আমি বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে বের হই। মা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন, সামনের বড় রাস্তা দিয়ে স্টেশনে যাচ্ছি। সেদিন আনোয়ারা দৌড়ে এসে কী মায়াবী কণ্ঠে বলল- ভাইজান, মা তোমাকে ওদিকে খুঁজতে গেছে। তখন আমাদের বাড়ি থেকে স্টেশনে যাওয়ার দুই দিকেই পথ ছিল। আমি ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে পুনর্বার কথা বলে এসেছিলাম। বলেছিলাম, মা, আমার জন্য চিন্তা করো না; কয়েক দিন বাদেই চলে আসব। এই যে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়।
মা বললেন, 'সাবধানে যাইয়ো বাবা।' এসব কথোপকথন আর দৃশ্যপট আমাকে অনবরত মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি শিশুর মতো অবুঝ হয়ে পড়েছিলাম।
৪. ভৈরব বাজার স্টেশনে ট্রেনটা খুব অল্প সময়ের জন্য থেমেছিল। রাত তখন ১১টা ৪০ হবে। আমাকে কিশোরগঞ্জের দিকে আরও পাঁচটি স্টেশন পেরিয়ে যেতে হবে। কিশোরগঞ্জ তখনও মহকুমা শহর। বছরখানেক বাদে এটি জেলায় উন্নীত হয়। ভৈরব স্টেশন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আজ বিলম্বের কারণে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেন একটু পরেই পৌঁছে যাবে। এটা নাকি আমার ভাগ্য। অন্যথায় সারারাত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাটাতে হতো। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনটা এলেই আমি এতে উঠে বসি। আমাকে পঞ্চম নম্বর পার হয়ে ষষ্ঠ নম্বর স্টেশন মানিকখালীতে নামতে হবে। বসার আসন নেই। কাজেই হ্যান্ডেলে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে। ঘণ্টাখানেক পর আমার গন্তব্য ও নির্ধারিত স্টেশনে নেমে যাই। মানিকখালী স্টেশনের অদূরেই আমাদের বাড়ি। হেঁটে যখন বাড়ি পৌঁছি, ঘড়ির কাঁটা রাত ১টার কাছাকাছি। উঠোনে দাঁড়িয়ে 'মা' বলে একবার শব্দ করতেই নিমেষে দরজাটা খুলে গেল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে উঠলেন। বাবা বিছানার ওপর পাথর হয়ে বসে আছেন। বাড়ি থেকে আমার শেষবার বিদায় নেওয়ার করুণ দৃশ্যের বর্ণনা করে মা বিলাপ করছিলেন।
সে রাতটাও পোহাল। ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মানুষের প্রতিদিনের পৃথিবী। সবাই যে যার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে দিগ্দিগন্তের ঠিকানায়। আমি নিভৃতে আনোয়ারার কবরের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি- হে আল্লাহ, আমার নিষ্পাপ ছোট বোনকে বেহেশত নসিব করুন।
হোসেন আবদুল মান্নান: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন