- মতামত
- দণ্ড ও মেরুদণ্ড
দণ্ড ও মেরুদণ্ড
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য যেভাবে এক কলেজ অধ্যক্ষকে মারধর এবং পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে ওই সংসদ সদস্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অধ্যক্ষও তা অস্বীকার করেছেন, তা একদিকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল ব্যবস্থাপনা; অন্যদিকে শিক্ষক সমাজের মেরুদণ্ডহীনতাকে স্পষ্ট করেছে। একটা সময়ে আইনের ফাঁক কাজে লাগিয়ে বিশেষ করে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা তাঁদের এলাকার প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই মাথায় বসে খবরদারি করতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১ জুন উচ্চ আদালত এক যুগান্তকারী আদেশ দেন, যা অনুসারে এলাকার কোনো স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে একজন সংসদ সদস্যের থাকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ বিধান কাগজে-কলমে যা-ই থাক; বাস্তবে যে অন্তত গোড়াগাড়ীতে মান্যতা পাচ্ছে না- তা পরিস্কার হয়ে যায় সংসদ সদস্যের ওই কলেজ অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনায়। শুক্রবার সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, গত ৭ জুলাই ওই অধ্যক্ষসহ এলাকার ১০ জন শিক্ষক সংসদ সদস্যের স্থানীয় কার্যালয়ে দেখা করতে যান। সেখানে সংসদ সদস্য অধ্যক্ষের কাছে সংশ্নিষ্ট কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা একটি অভিযোগ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চান। অধ্যক্ষ জবাবে বলেন, তিনি অভিযোগটি সম্পর্কে কিছু জানেন না এবং কেউ যদি এর সপক্ষে প্রমাণ দেন তাহলে তিনি ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সংসদ সদস্য আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অধ্যক্ষকে হাত-পা, এমনকি লাঠি ব্যবহার করে মারধর করেন। এখানে সংসদ সদস্য যেন নিজেই বাদী ও দণ্ডদাতা।
আমাদের বক্তব্য হলো, ওই কলেজে নিশ্চয় ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে, যেখানে সারাদেশের অভিজ্ঞতায় বলা যায়- নিশ্চয় সংসদ সদস্যের আশীর্বাদধন্য লোকরাই আছেন। সংশ্নিষ্ট আইন ও বিধি অনুসারে ওই কমিটি সংসদ সদস্যের উত্থাপিত অভিযোগের সুরাহা করতে পারত। কমিটি এতে ব্যর্থ হলে শিক্ষা বোর্ডসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাহায্য চাওয়া যেত। তা না করে সংসদ সদস্য নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে আইনপ্রণেতা হয়েও শুধু আইনের প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাননি; ওই কলেজের ব্যবস্থাপনারও দফারফা করেছেন। এ অবস্থায় সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কী শেখাচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরাই বা কী পাঠ নিচ্ছে- একটা বিরাট প্রশ্নম্ন হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রশ্নটা আরও জোরালো হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, ওই কলেজের অধ্যক্ষ সংসদ সদস্যের অন্যায় ও বেআইনি আচরণের শিকার হওয়ার পরও বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে তা বেমালুম চেপে যান। সংসদ সদস্যের পাশে বসে তাঁরই বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সাহস হয়তো ওই অধ্যক্ষের ছিল না। কারণ এতে তাঁর জীবিকার ওপর আঘাত আসতে পারে। কিন্তু এমন মেরুদণ্ড নিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াবেন কীভাবে? শিক্ষক তো শুধু একজন চাকরিজীবী নন; মর্যাদাবান মানুষেরও প্রতীক। অস্বীকার করা যাবে না- সমাজের সর্বত্র মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় চলছে, তা থেকে শিক্ষকরা মুক্ত থাকতে পারেন না। তবে এটাও মানতে হবে, দশকের পর দশক ধরে বিশেষ করে শাসকদলীয় সংসদ সদস্যের তাঁদের এলাকায় জমিদারগিরি চালানোর যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা সবাই জনগণের সেবকের বদলে এক ধরনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে পড়ছেন। আর তাঁদেরই প্রভাবে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যাঁরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তাঁরা যে এক ধরনের কর্তাভজাই হবেন- তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
যা হোক, রাজশাহীর ওই সংসদ সদস্য এর আগেও শিক্ষকদের হুমকি দেওয়া ও অপমান করার অভিযোগে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। তা ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শাসক দলের বিভিন্ন এলাকার আরও বহু সংসদ সদস্য ও নেতার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসবের কোনোটারই কোনো বিচার হয়নি। এ কারণেই স্থানীয় সংসদ সদস্য গোদাগাড়ীর ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটানোর ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছেন। শুক্রবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া ২৪ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরা তাই এর যথাযথ তদন্তপূর্বক বিচারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি। একই সঙ্গে শিক্ষক সমাজকেও পেশার মর্যাদা রক্ষায় জেগে ওঠার আহ্বান জানাই।
মন্তব্য করুন