- মতামত
- কারাবন্দি শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কারাবন্দি শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফাইল ছবি
আজ ১৬ জুলাই। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘মাইনাস ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের অপচেষ্টায় ২০০৭ সালের এই দিনে কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। নিত্যদিনকার অভ্যাস অনুযায়ী সেদিনও তিনি ফজরের নামাজ শেষ করেন। তার আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য সুধা সদন ঘিরে রাখেন; যেন এক রণ-প্রস্তুতি। নিতান্ত অমানবিকভাবে ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম কোর্টে; প্রেরণের আদেশ হয় কারাগারে। রাখা হয় তাঁকে সংসদ চত্বরে স্থাপিত সাব-জেলে। সেখানে দুঃসহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। শেখ হাসিনা রচিত 'সবুজ মাঠ পেরিয়ে' গ্রন্থে রয়েছে সেই দুঃখগাথার নির্মম উপাখ্যান।
১. শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দৃঢ়চেতা মনোবল আর অকৃত্রিম দেশপ্রেম সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গ্রেপ্তারের আগে দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা তেজোদীপ্ত চিঠি আর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তাঁর ৩৬ মিনিটের প্রদত্ত ভাষণ আমাদের ভগ্নহৃদয়কে আশান্বিত করেছিল, আমরা উজ্জীবিত হয়েছিলাম। মহানগর আওয়ামী লীগের সংগ্রহ করা ২৫ লাখ স্বাক্ষর, দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রতিবাদ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত অজস্র মানুষের অবিরাম প্রয়াস ও প্রার্থনার সঙ্গে যুক্ত হয় বাঙালির জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতিঘর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্জে ওঠা; বিশ্ববিদ্যালয়টি তার অতীত সংগ্রামী ঐতিহ্যের অনুসরণেই সেদিন শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যায়।
২. সেদিন ছিল সোমবার। শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমরা কালো ব্যাজ ধারণ করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ওই অন্যায় ও নির্মম গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ; অন্যদিকে এই প্রতিবাদের লেলিহান শিখা ছাত্র-শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বিক্ষোভ সমাবেশও করি। ক্যাম্পাসজুড়ে অবস্থান নেয় নানা বাহিনীর সদস্যরা; গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা নামে-বেনামে আন্দোলনে সম্পৃক্ত ও নেতৃত্বদানকারী শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানির অপপ্রয়াস চালায়। শেখ হাসিনার মুক্তির ব্যাপারে যেন কোনো কর্মসূচি পালন করা না হয় এবং নিজেরা যেন কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হন- এজন্য নেতৃস্থানীয় শিক্ষকদের প্রতি তারা নানান চাপ অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে কিছু আদর্শ-বিচ্যুত শিক্ষককে তারা নানান প্রলোভন দেখান, পদায়ন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন; সে মতে কিছু শিক্ষক নিজেদের বায়োডাটা নিয়ে নানান তদবিরেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যদিও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকরা এসব প্রস্তাব দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরিকল্পিত উপায়ে নানান কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন, যেন দেশের এই অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটে।
৩. শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের ১ মাস ৫ দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনা সংঘটিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে স্থাপিত সেনা ছাউনির জনৈক সেনাসদস্যের সঙ্গে খেলার মাঠে কিছু শিক্ষার্থীর প্রথমত বাগ্বিতণ্ডা এবং পরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে; যা দ্রুততার সঙ্গে গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্টের ঘটনা পরম্পরায় তৎকালীন স্বৈরাচারী ও উচ্চাভিলাষী সরকারের ভিত কেঁপে উঠেছিল; যার ফলে অন্য সব মানবতাবিরোধী স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও চড়াও হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। তারা ভেবেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শায়েস্তা ও পদানত করতে পারলে অথবা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই তাদের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে না। কিন্তু তাদের এ ধারণা যে শুধু ভুল ছিল তাই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাম্পাসে সৃষ্ট সেই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর মধ্য দিয়ে তাদের চরম অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার অসহায় চিত্রই তখন ফুটে উঠেছিল। ২০ আগস্ট ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের ঘটনার রেশ ধরে পরবর্তী দু'দিন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের বিক্ষোভ, সেনা ছাউনি প্রত্যাহার দাবি, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি এসবের ক্রমধারায় ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হন তৎকালীন শিক্ষক সমিতির দুই নেতা, যথাক্রমে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ; আত্মগোপনে থাকা অপর দুই শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন ও অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক পরবর্তী সময় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। উপরিউক্ত পরিস্থিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে তখন নতুন মাত্রা যোগ করে। শেখ হাসিনার মুক্তি দাবির সঙ্গে শিক্ষকদের মুক্তিদানের বিষয়টি যুক্ত হলে এ আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আন্দোলনে তখন মোটা দাগে ৩টি বিষয় জোরালোভাবে উঠে আসে। প্রথমত, শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি; দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। আমাদের আন্দোলনের ধাপসমূহের মধ্যে ৩টি ছিল অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, উপরিউক্ত ৩ দাবিতে গণমাধ্যমে ১৬৭ জন শিক্ষকের স্বাক্ষরসংবলিত বিবৃতি প্রদান; দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সমিতির তলবি সভা আহ্বান এবং তৃতীয়ত, নিপীড়ক সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ঘৃণা প্রকাশ আর ধিক্কারের প্রতীক হিসেবে কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় কালো পতাকা উত্তোলন। এই ৩টি ধাপ বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে ক'জন প্রতিশ্রুতিশীল আদর্শ শিক্ষকের জীবন বাজি রাখা আর অবিশ্বাস্য সাহসিকতা ও বীরত্বগাথার ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট সেই আন্দোলন পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের সকল রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, সর্বত্রই প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের ঝড় উঠতে থাকে এবং আন্দোলন ক্রমশ গণবিস্ম্ফোরণের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে; ফলে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যায় 'তিন উদ্দিন' তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি মুক্তি দেয় কারাবন্দি শিক্ষকদের এবং ১১ জুন শেখ হাসিনাকে কান ও চোখের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে শেখ হাসিনা সুধা সদনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিছু মানুষকে তাঁর সাক্ষাৎ দেন; সেই সুবাদে আমরা ১০-১২ জন শিক্ষকের একটি প্রতিনিধি দল সবশেষে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করি। তিনি আমাদের অসম সাহসী ভূমিকার উচ্চসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন, 'আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বিদেশ যাওয়ার আগে সবার শেষে আপনাদের সঙ্গে দেখা করলাম, দোয়া করবেন, বিদেশ থেকে ফেরত এসে সবার আগে আপনাদের সাথেই দেখা করব।' তাঁর এই প্রত্যয়ী ও প্রশংসাসূচক বক্তব্যে আমরা অভিভূত হলাম এবং কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে শুভকামনা জানালাম।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দল। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-শক্তির শিক্ষকদের এক আদর্শিক ও সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম। এ দলের নেতৃস্থানীয় শিক্ষকেরা দেশ ও জাতির নানা ক্রান্তিকালে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ওয়ান ইলেভেনের সেই দুঃসময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের অধিকাংশ কর্মসূচি প্রণীত হতো কলাভবনের তৃতীয় তলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে। তখন পুরো ক্যাম্পাসে এক ভয় ও আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। নানান বাহিনীর লোকেরা নিয়মিত টহল দিত এবং যাকে-তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহাল করত। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের জন্য কোনো কোনো শিক্ষকের বাসভবনে গভীর রাতে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা মহড়া দিতে থাকে। দুদক ও এনবিআরের মামলায় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেককেই তখন নির্বিচারে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এ রকম প্রতিকূল এক পরিবেশে নীল দলের নীতিনির্ধারক ও নেতৃস্থানীয় শিক্ষকবৃন্দ তখন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
৫. জননেত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে সরকারের শক্ত বাধা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের ডাকা হলো। আমরা ১৫-২০ জন শিক্ষক আবারও গেলাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আমরা তাঁর এক আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা মনোবল দেখতে পেলাম; অসম সাহসী ও প্রতিশ্রুতিশীল এক মানসচিত্ত তাঁর মাঝে আমরা আবিস্কার করলাম। তিনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে জাতীয় নির্বাচনের কথা বললেন, নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানালেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বহুল প্রত্যাশিত সেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট মহাবিজয় লাভ করল। কারাবন্দি, নির্যাতিত জননেত্রী হলেন প্রধানমন্ত্রী। আর তখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকর ও ফলপ্রসূ নেতৃত্বেই মূলত শুরু হলো আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা; যা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্যই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
স্মর্তব্য যে, জননেত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি ও দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সেই আন্দোলনের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান; বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ তার এক গর্বিত শিক্ষার্থীর চরম দুর্দিনে তাঁর জন্য সময়োচিত, অনন্য ও মহিমাময় ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একই সূত্রে গাঁথা; যা কেউ কখনও বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন