উন্নয়নশীল দেশ থেকে উতরে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে বাংলাদেশের এখনও প্রায় দুই দশক বাকি। রূপকল্প অনুযায়ী, ২০৪১ সালে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, শিল্প, যোগাযোগ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষিসহ সব খাত সমৃদ্ধ ও উন্নত থাকবে। এ লক্ষ্য অর্জনে জনসংখ্যা ও জনসক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার মধ্যগ বয়সও গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিকভাবে ১৯৫০ সালে একজন জন্মগ্রহণ করলে মাত্র ৪৭ বছর বেঁচে থাকত। কিন্তু ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ৭২ বছর হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যগ বয়স ছিল ১৯৫০ সালে মাত্র ২৯ বছর। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪২। জনসংখ্যার এই মধ্যগ বয়সের সূচকটি দিয়েই জনসংখ্যার বার্ধক্যের সম্পর্ককে সহজে জানা যায়। এ ছাড়া জনসংখ্যার বার্ধক্যের পরিমাপ হিসেবে নির্ভরতা অনুপাতও ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ কর্মক্ষম লোকদের (১৫ থেকে ৬০) তুলনায় বয়স্ক লোকদের অনুপাত।
বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার বার্ধক্যের ধারণাটির সূচনা ঘটলেও বাংলাদেশে এর সূচনা ঘটেছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ফলপ্রসূ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে নিম্ন টিএফআর (উর্বরতার হার) অর্জন; পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মৃত্যুহার কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে বয়স্ক লোকের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মধ্যগ বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিও পরোক্ষভাবে সমাজে বয়স্ক, এমনকি এক ধরনের তরুণ লোকের সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি করে। ফলে উন্নত বাংলাদেশের পূর্ব এবং পরবর্তী পরম্পরায় জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বার্ধক্যে উপনীত হবে, এটা স্বাভাবিক এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি দ্রুত বাড়বে। সমাজ ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব সরাসরি অনুভূত হবে; রাজনীতির ক্ষেত্রে এর প্রভাব যথেষ্ট পড়বে।
শ্রমশক্তির বণ্টন, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার পরিধি বাড়বে। সময়মতো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে জনসংখ্যা যেমন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়, তেমনি জনসংখ্যার বার্ধক্যের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করলেও জনসংখ্যার বার্ধক্যের ব্যাপারটিও একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আবার যৌক্তিক সময়ও প্রয়োজন।
সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যার বার্ধক্য সঞ্চয়, বিনিয়োগ, প্রকৃত সুদের হার এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিপ্রবাহের ওপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, জনসংখ্যার বার্ধক্য পুঁজির প্রবাহকে আরও কম দ্রুত বার্ধক্যযুক্ত দেশগুলোতে চালিত করতে পারে, যা দেশ ও অঞ্চলের আর্থিক স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক শক্তির বৈশ্বিক বণ্টনের অবধারিতভাবে পরিণতি ঘটাতে পারে। বিপরীতে প্রবীণরা সমাজে অনেক কিছু দিতে পারেন। এমনকি যখন বয়স্ক লোকেরা বেতন ছাড়া কাজ করেন, যেমন নাতি-নাতনিদের যত্ন নেওয়া, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা, বাড়ির আশপাশে কিংবা বাগান বা খোলা জায়গায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা ইত্যাদি।
বিশ্বায়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন (যেমন সহজ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা), আধুনিক নগরায়ণ, আবাসন, অভিবাসনসুলভ; অগ্রাধিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার; ভাতা ও পেনশনের বিস্তৃতি এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপায়ে বয়স্ক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করবে। তাই এসব বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের ভূমিকাকে অগ্রগণ্য রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো উচিত।
পৃথিবীর অন্যতম জনসংখ্যার ঘনত্বের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার কাঠামোগত রূপান্তর চোখে পড়বে সহজেই। অধিক ঘনত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কারণে বার্ধক্যের সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে চিরাচরিত নিয়ম, রীতিনীতি কিংবা কর্মকৌশলের মাত্রা ব্যাপকতা ও ভিন্নতা পাবে নিঃসন্দেহে। যেমন করোনাভাইরাস মহামারির মতো মহামারির ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে; ঠিক যেমনটি ঘটছে বর্তমানে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে; যেখানে প্রবীণের সংখ্যা অনেক।
যে কোনো দেশের জনসংখ্যা স্থির হলে, অর্থাৎ টিএফআর ২ দশমিক ১ প্রতিস্থাপন মাত্রায় গেলে বছর বছর অন্তর ক্রমে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির ঘাটতি দেখা দেয়। পক্ষান্তরে জনসংখ্যার বার্ধক্য সমস্যা আরও প্রকট হয়। ২০২০ সালের দিকে বিশ্বের সবচেয়ে কম টিএফআর দেশের মধ্যে ছিল দক্ষিণ কোরিয়া; যেখানে গড়ে প্রত্যেক নারী ১ দশমিক ১টি সন্তানের জন্ম দেন; সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান ১ দশমিক ২; বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ও ইউক্রেনের ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৩। বাংলাদেশের টিএফআরের পরিমাণ প্রতিস্থাপন মাত্রার কিছুটা ওপরে অবস্থান করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ফলে বহু বছর পরে হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন একটি সময় আসতে পারে।
প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বর্ধিত দীর্ঘায়ু, যা মানবকল্যাণে একটি প্রকৃত উন্নতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং সামাজিক ব্যয় মেটানোর জন্য করের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সরকারগুলোর জন্য একটি সম্ভাব্য আশীর্বাদও বটে। এ সত্ত্বেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জনসংখ্যার বার্ধক্যের সমস্যাগুলোকে বড় করে দেখা হয়, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। আবার এ সমস্যা মোকাবিলায় সামাজিক বীমা ও পেনশন সংস্কারও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অবসরের বয়স বৃদ্ধি করে দীর্ঘ কর্মজীবনকে উৎসাহিত করলে অবসর গ্রহণের জন্য আরও ব্যক্তিগত সংস্থান এবং সরকারি সহায়তার জন্য আরও আয়কর রাজস্ব তৈরির সুযোগ বাড়বে।
১৯৬০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে যখন বিশ্বের জনসংখ্যা ৩ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৬ বিলিয়নে পৌঁছেছিল, তখন অনেকে অনেক ধরনের ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং সেগুলো সবার কাছে খুব মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই সময়সীমার মধ্যে মাথাপিছু বিশ্বব্যাপী আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছিল; জীবনী প্রত্যাশা ১৫ বছরেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার অনেক দেশে সর্বজনীনতার কাছে পৌঁছেছিল।
জনসংখ্যার বার্ধক্য সন্দেহাতীতভাবে অগণিত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। কিন্তু এটাও ঠিক, তার অগণিত সম্ভাব্য সমাধানও রয়েছে। আমাদের সামনে কাজটি হলো, ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে কোনটি গ্রহণ করা সর্বোত্তম, তা অনুসন্ধান; রাজনৈতিক ও সামাজিক ইচ্ছা এবং আর্থিক পেশিকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করা, যাতে আমরা আগামী দুই দশকেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।
ড. মো. হাসিনুর রহমান খান: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়