দেখতে দেখতে ফকির আলমগীরবিহীন এই সংসারসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। গত বছরের ২৩ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান পরিবার-পরিজনসহ অসংখ্য ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে।

গণমানুষ, গণসংগীত, ফকির আলমগীর যেন সমার্থক শব্দ। পড়াশোনা করেছেন গণযোগাযোগে। গান গেয়েছেন গণসংগীত, চাকরি করেছেন জনসংযোগে। ৪৪ বছর ধরে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা এই মানবতার গায়ক, এ গুণী মানুষটিকে যতই দেখেছি, ততই বিস্মিত হয়েছি। ফকির আলমগীর একজন সংগ্রামী মানুষের নাম। সারাজীবন কেটেছে তাঁর লড়াইয়ে। দেশের জন্য লড়াই, নিজের বেঁচে থাকার লড়াই। পদ্মাপাড়ের মানুষ ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার অন্তর্গত কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পদ্মার উজান স্রোতে শত প্রতিকূলতায় একমাত্র নিজের প্রচেষ্টায়, বাবা-মায়ের দোয়ায় তিনি দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। নিভৃত পল্লির মাটি, মানুষ, ফসলের সোহাগি-সৌরভ কপালে মেখে তিনি উঠে এসেছেন নাগরিক রাজপথে। ফকির আলমগীর পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশাত্মবোধের চেতনায় উৎসারিত গণমানুষের গানের মালা আর জাতীয় পতাকা সঙ্গে নিয়ে। সুরে শিহরণে ছড়িয়ে দিয়েছেন আউল-বাউল ভালোবাসা। গানে গানে বলেছেন, অবহেলিত, লাঞ্ছিত জীবনের বেদনায় আর্তি আর সম্ভাবনার কথা।

ফকির আলমগীর নিজ গ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন ১৯৬৬ সালে কালামৃধা-গোবিন্দ হাইস্কুল থেকে। এরপর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন উচ্চমাধ্যমিকে। বিকম পাস করে পরবর্তীকালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে। সফলতার সঙ্গে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স পাস করে চাকরি নেন বিসিআইসিতে। ৩০ বছর সরকারি চাকরি শেষ করে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে এলপিআরে আসেন ২০০৭ সালে। '৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে শিল্পী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ গানের বন্ধাভূমিতে দেশজ ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা গানে নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। সংগীত ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য তাঁকে করে তোলে আরও প্রগতিশীল গণমুখী ও জনপ্রিয়। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধে তিনি গড়ে তোলেন গণসংগীতের এক ভ্যানগার্ড। নাম দিলেন ঋষিজ। ১৯৭৬ সালে এ সংগঠনটির জন্ম। জীবদ্দশাতে প্রায় পঁচিশটি বই লিখে গেছেন। আরও প্রায় ১৫টি বইয়ের পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে রেখে গেছেন।

গণসংগীতের এই গুণী শিল্পী জীবনের সাধারণ মানুষের অজস্র ভালোবাসা পেয়েছেন। দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ, চ্যানেল আই মিউজিকের আজীবন সম্মাননা, গণনাট্য পুরস্কার, ত্রিপুরা সরকার কর্তৃক সম্মাননা-২০০৫, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সংগীতে মহাসম্মানসহ আরও অনেক পুরস্কার। ঋষিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছাড়াও তিনি বহু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি, বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা। পল্লীমা সংসদের আজীবন সদস্য, ধূমপানবিরোধী সংগঠন 'আধূনিক'-এর সদস্য, খিলগাঁও সামাজিক সংস্থার উপদেষ্টা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিষদের সদস্য, অফিসার্স ক্লাবের সদস্য ছিলেন। আমাদের ৪৫ বছরের সংসার জীবনে তিন পুত্রসন্তান রানা, রাজীব ও রাহুল। বর্ণাঢ্য ও সফল জীবনের অধিকারী ফকির আলমগীর বেঁচে থাকবেন এ দেশের সব মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান, চিরভাস্বর হয়ে। বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে। গত বছরের ২৩ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে এই চিরতরুণ-চিরসবুজ মানুষ ইন্তেকাল করেন। সবার কাছে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া প্রার্থনা করি।

সুরাইয়া আলমগীর: প্রয়াত ফকির আলমগীরের সহধর্মিণী এবং সভাপতি, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী