গত ১৯ জুলাই মঙ্গলবার ইরানের তেহরানে ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন ২০১৯ সালের পর রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের শীর্ষ নেতাদের প্রথমবারের মতো একত্র করেছে। তাঁদের বৈঠকে অনেক সাধারণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, তবে সেটা হয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ এজেন্ডায়। এমনকি এ বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সব বিষয়ে একমত হয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন এবং প্রত্যেকের জন্যই তা গুরুত্বপূর্ণ।

তেহরান বৈঠকটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেদ্দায় সৌদি আরবের আমন্ত্রণে উপসাগরীয় সহায়তা সংস্থা জিসিসির নেতাদের অংশগ্রহণে একটি বিশেষ উঁচু স্তরের বৈঠকে অংশ নেন। ওই বৈঠকে জর্ডান, মিসর ও ইরাকের প্রধানরাও অংশ নেন। যদিও জেদ্দা সম্মেলনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যেখানে সম্মেলনটির মাত্র দুই দিন আগেই জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করেন এবং বিশেষ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। যখন তথাকথিত জেরুজালেম ঘোষণার প্রধান বিষয় ছিল ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে অনুমতি না দিতে প্রতিজ্ঞা করা। জেদ্দা সম্মেলনের বার্তা এমনভাবে দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে আরবের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পথ খোলা রাখা হয়।

জেদ্দা থেকে প্রাপ্ত সংবাদের বার্তাকে ইরানি নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে সাধুবাদ জানাবেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, তেহরানের (ইরান) প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিতকরণ অব্যাহত রাখছে রিয়াদ (সৌদি আরব)। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা ইরানে একজন দূত পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে। আরব আমিরাতের এ অবস্থানও তেহরান স্বাগত জানিয়েছে।

কিন্তু তেহরানে মিলিত হওয়া নেতাদের বিবেচনার জন্য অন্য বিষয়ও রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ইরানের সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ কৌশলগত চুক্তি করতে আগ্রহী। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, মস্কোর (রাশিয়া) ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি জোট গঠন করা। তেহরান চাইলে পুতিনের সঙ্গে একমত হতে পারে কিন্তু পশ্চিমা তেল নিষেধাজ্ঞা কাটানোর মতো সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে না। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা কামাল খারাজি গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, তেহরানের একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি এখনও সম্ভব। এই মুহূর্তে মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমাবিরোধী জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তেহরান ওই চুক্তির সম্ভাবনার কফিনে পেরেক ঠুকতে চাইবে না।

আমেরিকার বিপরীতে যে কোনো দেশ থেকে সমর্থন পাওয়া ভদ্মাদিমির পুতিনের জন্য ভালো বিষয়। কিন্তু এ ধরনের সমর্থনের সীমাবদ্ধতা আছে। রিয়াদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে তেহরানের ব্যাপক ভূরাজনৈতিক মূল্য রয়েছে। এমনটা হলে আঞ্চলিক অনেক বিরোধেরই সমাপ্তি ঘটবে। আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিবেশী হিসেবে দিন শেষে ইরান তার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একজন বাস্তববাদী নেতা, প্রয়োজনে কাউকে পাশ কাটানো কিংবা পক্ষ বদলে তাঁর কোনো অস্বস্তি নেই। তাঁর অবস্থানের দৃঢ়তা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দুটি দেশের ওপর তাঁর প্রভাব তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে এবং তার বাইরেও অন্যতম প্রধান ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। তিনি উত্তর সিরিয়ায় কয়েক সপ্তাহের জন্য একটি ব্যাপক সামরিক হামলার হুমকি দিয়েছেন। তবে মস্কো ও তেহরানের এ হামলার ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। আঙ্কারা কেন উত্তর সিরিয়ায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক হামলায় জড়িত হচ্ছে তা বোঝা কঠিন। ইরান এর বিরোধিতা করে বলেছে, যে কোনো ধরনের হামলা সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। মস্কোও সিরিয়ায় তুরস্কের এ ধরনের হস্তক্ষেপে খুশি নয়।

এসব বিবেচনায় রেখেও এটা বলা দরকার, জো বাইডেনের সফরে ইসরায়েলের জেগে ওঠা তেহরানের জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ। গত সোমবার ইসরায়েলি আর্মিপ্রধান আবিব কোচাবি বলেছেন, তাঁদের সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েল ও ইরান এমনিতেই কয়েক বছর ধরে পরোক্ষ যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল ইরানে হামলা করলে, তা কাউকেই সন্তুষ্ট করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো কিংবা আরব বিশ্বের কেউই ওই অঞ্চলে এমন অনিশ্চিত যুদ্ধ দেখতে চায় না। তবে এটা ঠিক, ওই অঞ্চলে কোনো যুদ্ধের ইন্ধনের বিষয় এলে ইসরায়েলকে একাই তা করতে হবে।

তেহরান সম্মেলনে তিন নেতার ফটোসেশনের সুযোগ মিলেছে, সেখানে কিছু জ্বালাময়ী বিবৃতিও আমরা দেখেছি এবং একটি চুক্তির ব্যাপারে তাঁরা ঐকমত্য হয়েছেন। যদিও প্রত্যেকের ব্যক্তি এজেন্ডা ভিন্ন, তারপরও অভিন্ন চ্যালেঞ্জ তাঁদের একত্র করেছে। এর ভবিষ্যৎ কী হবে সময়ই তা বলে দেবে।

ওসামা আল-শরিফ: জর্ডানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক; আরব নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক