
তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)
১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)। এরপর ঘটনাচক্রে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের দেখা হয়। এই সাক্ষাতের কথা বহু বছর পর ভারতের কীর্তিমান কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের একটি পত্রিকাকে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালের মার্চে। জে এন দীক্ষিতের ভাষ্য ছিল, 'তাজউদ্দীন আহমদ একজন পশ্চিমা লেখকের কথা উদ্ধৃত করেছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, আমার খারাপ লাগছে যে, আপনি আর মন্ত্রিপরিষদে নেই। জানি না আগে আপনি শুনেছেন কিনা। তাঁর উদ্ধৃতিটা ছিল এরকম- প্রতিটি সফল বিপ্লব তার নায়কদের খেয়ে ফেলে।'
তাজউদ্দীন আহমদ এরপর আর খুব বেশিদিন বাঁচেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কুখ্যাত জেলহত্যাকাণ্ডে তাঁকেও খুন করা হয় একই বছরের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে। সত্যি সত্যিই স্বাধীন বাংলাদেশের সফল বিপ্লবের নায়কদের খেয়ে ফেলে প্রতিবিপ্লবীরা। তাজউদ্দীন আহমদের হত্যা-পরবর্তী পরিস্থিতির একটা বয়ান পাওয়া যায় ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত তাঁর স্ত্রী প্রয়াত রাজনীতিবিদ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের এক সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেছেন, 'তাজউদ্দীনের আত্মার মাগফেরাত কামনার জন্য কুলখানি করতে পারিনি। চল্লিশাও করতে পারিনি। কারণ, সেনাবাহিনীর লোকেরা আমার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিলেন দেড় মাস। বাসা তো তখন হন্টেড হাউস। আমরা পরে কোনোরকমে একটা মিলাদ করেছিলাম। সেটাও অনেক পরে। ভয়ভীতির মধ্যে করতে হয়েছিল। যাঁরা এসেছিল, তাঁরাও মিলাদের পর প্রায় দৌড়ে চলে গিয়েছিল। এমনই ছিল তখনকার পরিবেশ।'
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, তাজউদ্দীন আহমদ কখনোই স্বস্তিকর ছিলেন না প্রতিবিপ্লবীদের কাছে তো বটেই এমনকি তাঁর বিপ্লবের অনেক সহগামীর কাছেও। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর, তাজউদ্দীন আহমদের মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরও সেই পরিস্থিতির খুব একটা রদবদল ঘটেনি। এখনও প্রতিপক্ষের কাছে তিনি শুধু চক্ষুশূলই নন, বিরুদ্ধ শক্তিও বটে!
তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে- তাজউদ্দীন আহমদের শক্তির উৎসটাই বা কী? কী ছিল তাঁর পথ ও মত? কেন তিনি এখনও দৃশ্যমান-অদৃশ্য শত্রুপক্ষের কাছে এতটা টার্গেট হয়ে আছেন? কেন প্রতিপক্ষ তাঁকে এত বড় শত্রু ঠাওর করে ইতিহাসের পথ আটকে বসে আছে? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হয়তো ভবিষ্যতের হাতে আছে। তবুও এককথায় বলা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ নৈতিক রাজনীতির যে চর্চা জীবনভর করেছেন, কোনো পরিস্থিতিতেই সেই পথ ছাড়েননি বলেই হয়তো এখনও এতটা উজ্জ্বল হয়ে আছেন। সেটাই হয়তো তাঁর সফলতার প্রধানতম ভিত্তি।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদকে একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'তাজউদ্দীন দেশকে জানতেন, বুঝতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি যেভাবে মোকাবিলা করেছিলেন, তাতে আমরা খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। সে সময় তাঁকে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে।'
তিনি সব সময় ছোটবড় সবাইকে মূল্য দিতেন। সবার কথা ধৈর্য ধরে শুনতেন। কখনও কিছু করতে বলার আগে নিজে সেটা করতেন। নিজেকে যাচাই করে নিতেন এভাবেই। তিনি কখনও প্রশংসা শুনতে পছন্দ করতেন না। বরং সমালোচনা শুনতেই উৎসাহ বোধ করতেন। সব সময় তিনি দেশের ভালোমন্দ সামনে রেখেই কথা বলতেন। একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষ বলা যায় তাঁকে।
তাজউদ্দীন আহমদ মাত্র ৫০ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। কিন্তু এই স্বল্পায়ু জীবনেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মতো বড় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দি, তখন তাজউদ্দীন আহমদ সেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দেশ স্বাধীন করা এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিত ফিরিয়ে আনার মতো সফল ও অসামান্য কাজে যুক্ত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর সম্পর্কে তাই শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিমের বয়ান ছিল- 'তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সাথীদের অন্যতম সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের গতিপথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন। যিনি ইতিহাসের সঙ্গে গেছেন।'
তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতি এবং আইনের ছাত্র হলেও বিশ্ব ইতিহাসের পঠন ছিল তাঁর করায়ত্ত। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে, 'আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে, তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।'
তিনি নির্দি্বধায় বলতেন, 'মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।'
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন আহমদের গ্রামের বাড়িটি ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি আর্মিরা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো গ্রামের সেই পোড়া বাড়িতে গিয়েছেন তিনি। তাঁকে দেখতে এসেছেন গ্রামের অনেক মানুষ। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন তাঁকে বললেন, আর চিন্তা কী, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে। এই কথার উত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না। তিনি আরও বললেন, 'মনে রাখবেন, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না। আমি সমস্ত বাংলাদেশের। এখন আপনাদের দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশি। কারণ সমস্ত দেশের মানুষ আপনাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে।'
এ কথা বলার পর তিনি সহজ ভাষায় উদাহরণ টেনে বললেন, বাড়িতে যখন অতিথি-মেহমান আসে তখন আমরা কী করি? তাঁকে ভালো করে আদর যত্ন করি, তাঁর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। তাঁকে সবচেয়ে ভালো জিনিসটা খেতে দেই। এরপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাই। আপনারাও বাংলাদেশকে তেমনিভাবে দেখুন। আসুন আগে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি, তখন এই এলাকা এমনিতেই পিছিয়ে থাকবে না।
এই ছিল পুরোদস্তুর গণতান্ত্রিক, মানবিক, কল্যাণমুখী অর্থনীতির আকাঙ্ক্ষী, দেশপ্রেমিক, সৎ তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। ফলে দলের মধ্যে ও দলের বাইরে সর্বত্রই একদল স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদী, অগণতান্ত্রিক, অনাদর্শিক মানুষের সঙ্গে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে জীবনভর। এমনকি মৃত্যুর এত বছর পর আজও সেসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধতা তাঁর পথকে প্রতিরোধ করতে সচল আছে।
তাজউদ্দীন আহমদ সাম্যের বাংলাদেশ চেয়েছেন, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের অন্যায্য আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছেন, সব ধরনের এজেন্সি-নির্ভর সংস্কৃতির বদলে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের গণতান্ত্রিক ন্যায়ানুগ মর্যাদাবান রাষ্ট্র চেয়েছেন। এক অর্থে সেটাই ছিল তাঁর পথ। সে রাজনৈতিক পথে জীবনভর হেঁটেছেন কোনোরকম আপস না করেই। আজও তাই তাজউদ্দীন আহমদের শত্রুদের নিশানা বদল হয়নি।
২৩ জুলাই তাঁর ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
শুভ কিবরিয়া: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
kibria34@gmail.com
মন্তব্য করুন