দেশের শেয়ারবাজারের ওপর আস্থাহীনতা চলে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা বের হয়ে যাচ্ছেন। এই বাজারে জুয়াড়ি সৃষ্টি হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা চলে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এখন আমরা দেখছি প্রায় প্রতিনিয়ত দরপতন ঘটছে। এভাবে ধারাবাহিক দরপতনের ফলে একসময় দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র চলে যাবেন। এভাবে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না।

দেশের শেয়ারবাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করেন, কীভাবে কারসাজি করা হয়, তার সর্বশেষ একটি চিত্র আমরা দেখতে পেলাম সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। এই খবরে আবারও আলোচনায় শেয়ারবাজার। ১৭ জুলাই সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে কীভাবে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। একদিকে দেশের জ্বালানি সংকট এবং আরেকদিকে সমকালে প্রকাশিত এই খবরের পরেই যেন শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। কিন্তু এভাবে কেবল একজন জুয়াড়ি তাঁর কারসাজির মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তা নয়। এমন আরও বাজিকর রয়েছেন।

প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো শুধু নামেই নন, শেয়ারবাজারের অঘোষিত হিরো- যেন তাঁর হাতে আছে রাতারাতি ধনকুবের হওয়ার জাদুর কাঠি। শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এই হিরো। শেয়ার কারসাজির আয়ের টাকায় এখন বেশ কিছু কোম্পানির মালিকও বনে গেছেন তিনি। এই হিরোর ঘটনা থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি, এ রকম আরও হিরো আছে, যাঁরা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে এসব হিরোর কারসাজির প্রমাণ থাকার পরেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এসব কারবারি কোনো ব্রোকারেজ হাউস থেকে কীভাবে এবং কার সঙ্গে মিলে কোন শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছেন, সব তথ্য বিএসইসি জানে। কিন্তু এসব লোকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আমাদের সামনে খুব একটা নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না। সমকালের ওই প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে, খোদ বিএসইসির চেযারম্যান একাধিক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে রীতিমতো নাম ধরেই হিরোর প্রশংসা করেছেন; বলেছেন, এ হিরোরাই নাকি শেয়ারবাজারকে টিকিয়ে রেখেছেন। এই পুরো বিষয়টি শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো। বিএসইসির আশ্রয়-প্রশ্রয়েই যে এসব জুয়াড়ি ও কারসাজির সঙ্গে জড়িত হিরোদের টাকা কামানোর পথ সহজ হয়, তা বলার জন্য কোনো বিশ্নেষক হতে হয় না।
বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে সরকারি কাজে নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে ব্যবসাসহ প্রতিষ্ঠানের মালিকানার প্রশ্নে বিভিন্ন নিয়ম মানতে হয়। পাবলিক সার্ভেন্টস (কন্ডাক্ট) রুলসের ১৫ ধারায় সুস্পষ্ট বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা যে কোনো ধরনের স্পেকুলেটিভ বা অনুমানভিত্তিক কোনো ব্যবসায় (যেখানে দর খুব দ্রুত ওঠানামা করার সুযোগ আছে, যেমন- শেয়ার ব্যবসা) অভ্যাসগতভাবে জড়িত হতে পারবেন না। এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও এ কাজে জড়িত হতে তিনি দেবেন না, যদি সরকারি কাজ তাতে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ থাকে। অথচ নিজের শেয়ার কারসাজির সুবিধার জন্য হিরো নিজে একের পর এক সমবায় সমিতিকে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত করেছেন। নামসর্বস্ব সমবায় সমিতি খুলে এর মাধ্যমে কারসাজি করেছেন। আসলে একজন হিরোর হিরোগিরি সামনে আসায় কেবল তাঁর ঘটনাই জানা যাচ্ছে। এমন আরও হিরো নিশ্চয়ই রয়েছেন, যাঁরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।

পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা ভালো শেয়ারের অভাব। পুঁজিবাজারের গভীরতার অভাব। সরকার যদি ভালো ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য উদ্যোগ নেয়, তাহলে এটা হবে সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, দেশীয় ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অন্ততপক্ষে বছরে যদি একটা ভালো কোম্পানিও পুঁজিবাজারে আনতে পারে, সেটাও অনেক বড় অর্জন হবে। এতে পুঁজিবাজারের গভীরতাও বাড়বে। স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কেটে থাকলে আস্থা বাড়বে। শুধু যে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়বে তা নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এতে আকৃষ্ট হবেন।

সম্প্রতি সরকার দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে। আমি মনে করি, অতীতের তুলনায় নতুন গভর্নর আরও বেশি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে তার নিয়ন্ত্রণে রেখে ভালোভাবে শেয়ারবাজার তদারক করতে পারে। দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংককে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে ইন্স্যুরেন্সসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে, তাদের একটি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এবং পতনের মুখে থাকা শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে এই উদ্যোগ নিতে হবে। আমি আশাবাদী হতে চাই, নতুন গভর্নর ভালো করবেন। কারণ, অর্থনীতির মূল জায়গাগুলো সম্পর্কে তাঁর ভালো জ্ঞান আছে। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ (রাজস্ব) সম্পর্কে তাঁর ভালো ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে জানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভালো হতে বাধ্য।

এখন যেভাবে শেয়ারবাজার আস্থার সংকটে ভুগছে, তা নিরসনে এবং শেয়ারবাজারের দুর্দশা কাটাতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। শুধু সরকারই পারে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি ব্যাংকগুলোকে এখন শেয়ার কিনতে হবে। এ ছাড়া শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার উপায় নেই। যেসব দুষ্টু ও মন্দ প্রকৃতির লোক শেয়ারবাজার নিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে মত্ত, তাঁদের চিহ্নিত করে প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত হিরোদের বিচার না করা হলে, তাঁদের হিরোগিরির মুখোশ না খুললে এ অবস্থার খুব উন্নতি হবে না। তা না করতে পারলে ব্যাংক খাতের পর শেয়ারবাজারও একেবারে আস্থাহীন হয়ে পড়বে। আর এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে সরকার কীভাবে তার কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জন করবে?

আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে- এ কথা সত্যি। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়ম কমিয়ে শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা গেলে তা সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। এতে পুঁজি সংগ্রহের জন্য ব্যাংকনির্ভরতা কমবে। এর ফলে ব্যাংক খাতে যেমন সুস্থতা আসবে তেমনি শেয়ারবাজার হবে সত্যিকার অর্থে দেশের শিল্পায়নে পুঁজি সরবরাহকারী। দেশের জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাকে টেকসই করতে হলে সুস্থ ও তেজি শেয়ারবাজারের কোনো বিকল্প নেই।

অধ্যাপক আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়