ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে তাঁর বাহিনীর হাতে নিহত বাংলাদেশিদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত ও অশোভনই নয়; নিন্দনীয়ও বটে। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদরদপ্তরে পাঁচ দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সীমান্তে তাঁর বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত যত বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, তাঁদের সবাই ছিলেন মাদক, গরু চোরাকারবারিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে, ২০০১-১০- এ দশ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন। এরপরও প্রতি বছর কয়েক ডজন করে নিরীহ বাংলাদেশি ওই সীমান্তে একইভাবে খুন হচ্ছেন। আজ পর্যন্ত এসবের একটি ঘটনারও তদন্ত হয়নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিএসএফপ্রধান এমন একটি আপত্তিকর মন্তব্য করলেন? তাঁর এ মন্তব্যকে যদি ঈশপের গল্পের সেই নিরীহ মেষশাবককে খাওয়ার জন্য নেকড়ের দেওয়া ছলের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে বোধ করি খুব একটা ভুল হবে না। আন্তর্জাতিক কোনো আইনে নেই যে অনুপ্রবেশকারী কাউকে গুলি করা যাবে। এমনকি বেআইনি সীমান্ত পারাপারের ঘটনা যদি রাতের বেলায়ও ঘটে, তাহলেও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি হলো, সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিকে আটক করে সে দেশের আদালতে সোপর্দ করা। এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই যে আজ পর্যন্ত যেসব বাংলাদেশি বিএসএফের ওই বর্বরতার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে গরিব ও সীমান্ত এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের পক্ষে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত বিএসএফ জওয়ানদের আক্রমণ করা সম্ভব- এ কথা কোনো সুস্থ লোকের পক্ষে বিশ্বাস করা সত্যিই অসম্ভব।

আমাদের মনে আছে, ২০১১ সালে বাবার সঙ্গে কুড়িগ্রাম সীমান্ত পার হয়ে দেশে আসার পথে কী নির্মমভাবে হতদরিদ্র কিশোরী ফেলানিকে বিএসএফ খুন করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তার পরিবার ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ হত্যার ন্যায়বিচারের জন্য অনেক আবেদন-নিবেদনের পরও তদন্ত ও বিচারের নামে একটা প্রহসন ছাড়া আজ পর্যন্ত ভারত সরকার কিছুই করেনি। আরও উল্লেখ্য, সীমান্তে কোনো প্রকার মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে না বলে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বিএসএফ গুলি করে হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, গুলি ছাড়াও আরও বহু কৌশলে বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করে। গত মাসের শেষের দিকে মা-বাবার সঙ্গে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্ত পার হওয়ার সময় বিএসএফের ধাওয়া খেয়ে কীভাবে দুটি অবোধ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, সে কাহিনিও সমকালেই আমরা পড়েছি। এমনও দেখা গেছে, বিএসএফের ইন্ধনে সীমান্ত এলাকার ভারতীয় অনেকে এপারের মানুষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জখম ও হত্যা করেছে। বিশেষ করে সিলেট সীমান্তে বহুবার আমরা এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আখাউড়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিএসএফ জওয়ানরা কয়েক বছরে কতবার যে অবৈধভাবে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে স্থানীয় লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এমন ঠান্ডা মাথায় বাংলাদেশিদের হত্যা করতে দেখেও আমাদের বিজিবি বা সরকার এসবের বিরুদ্ধে খুব জোরালো কোনো প্রতিবাদ করেছে- আজ পর্যন্ত তার কোনো নজির নেই। ভারত যে বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বাস্তবে তার উল্টোটা করে চলেছে, তারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের ভারতীয় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। সম্ভবত এ কারণেই বিএসএফপ্রধান বাংলাদেশের মাটিতে বসেই কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া সীমান্তে চালানো তাঁদের বর্বরতাকে জায়েজ করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছেন। আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শুধু নয়; দুই দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির স্বার্থেও সীমান্ত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। তার জন্য ভারত সরকারকে যেমন ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি বাংলাদেশ সরকারকেও আরও জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। দুই দেশের সচেতন মানুষও এ ব্যাপারে সোচ্চার হবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।