সাতবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া। ১৯৮৬, '৮৮, '৯১ ও '৯৬ সালে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরশাদ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। দল ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে পরাজিত হন। মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ধরে রাখা এ আইন প্রণেতা ২০০৮, '১৪ ও '১৯ সালে পরপর ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে রাব্বী মিয়াকে দশম সংসদের ডেপুটি স্পিকার করা হয়। একাদশ সংসদেও আমৃত্যু তিনি ছিলেন ডেপুটি স্পিকার।

ছিলেন কথাটি বলতে কষ্ট হচ্ছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৯ মাস যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে না ফেরার দেশে চলে যাওয়াদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়ে তিনি হয়ে গেলেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার। ১৯৪৬ সালের ১৫ এপ্রিল জন্ম; বাংলাদেশের গড় আয়ু বিবেচনায় ৭৬ বছর ৩ মাস বয়সে প্রয়াণকে অকাল মৃত্যু বলা সমীচীন হবে না। তবে ফজলে রাব্বী মিয়ার মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও আইন প্রণেতার এ সময়ে চলে যাওয়াটা দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি আরও অনেক দিন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আলো ছড়াতে পারতেন। বয়সের ভার তাঁকে কাবু করতে পারেনি। সুঠাম দেহের অধিকারী ফজলে রাব্বী মিয়া স্পিকারের আসনে বসলে মনে হতো সিংহাসনে রাজা বসে আছেন।

সংসদ কার্যক্রম পরিচালনায় ফজলে রাব্বী মিয়ার বিচক্ষণতা ও তীক্ষষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ফুটে উঠত। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পক্ষপাতের অভিযোগ নতুন বিষয় নয়। কিন্তু ফজলে রাব্বী মিয়া যখন স্পিকারের আসনে বসতেন, তখন তিনি পুরো সংসদের অভিভাবক হিসেবে সরকারি দল-বিরোধী দল- সবার স্পিকার হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই বলে কোনো সংসদ সদস্য অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতাকে নিয়ে কটাক্ষ করার চেষ্টা করলে নীরব থাকেননি। মাইক বন্ধের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক কঠোর জবাব দিয়েছেন। শক্ত শব্দ চয়নেও কার্পণ্য করেননি। যদিও তাঁর সেই কঠোরতার চিত্র কখনও কখনও বিরোধীপক্ষ নেতিবাচকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।

একবার সংসদ অধিবেশনে একজন প্রবীণ সদস্য সংবিধানের একটি জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। মনে আছে, ওই সংসদ সদস্য বলছিলেন- মাননীয় স্পিকার, আপনি এই মুহূর্তে চেয়ারে না থাকলে এ বিষয়টি বলতাম না। প্রবীণ এই সংসদ সদস্যের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যেই সংবিধান ও আইন বিষয়ে ফজলে রাব্বী মিয়ার পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায়। অনেক সময় পণ্ডিত ব্যক্তি বলে পরিচিত কাউকে কাউকে অহংকারবোধ গ্রাস করতে দেখা যায়। কিন্তু ফজলে রাব্বী মিয়াকে সেই রাহু কখনও গ্রাস করতে পারেনি। স্পিকারের সঙ্গে বয়স ও অভিজ্ঞতার ফারাক অনেক; কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে, এমন কথা দুষ্ট লোকও বলতে পারবে না। বিনয় আর ভদ্রতা দিয়েই সব জয় করেছেন তিনি।

বেশ কয়েক বছর আগে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে ফজলে রাব্বী মিয়ার সঙ্গে দেখা। ঢাকাস্থ রংপুর বিভাগ সমিতির পক্ষ থেকে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক হিসেবে পেশাগত দায়িত্বে আমিও ছিলাম। বৃহত্তর রংপুরের সংসদ সদস্য, প্রশাসন, পুলিশ ও কর ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার ডেপুটি স্পিকারকে প্রটোকল অনুযায়ী সম্বোধন করে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন, আমি আপনাদেরই একজন। মরলে কবরটা গাইবান্ধাতেই হবে। এত প্রটোকলের চিন্তা না করে আপনাদের ভাই হিসেবেই দেখেন। জন্মভূমির প্রতি কতটা ভালোবাসার গভীরতা থাকলে একজন মানুষ এভাবে বলতে পারেন!

যে কোনো মানুষ ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। এটা শুধু বৃহত্তর রংপুর নয়; দেশের সব নাগরিকের জন্য তাঁর দরজা সবসময় উন্মুক্ত থাকত। মৃত্যুর পর প্রবীণদের পাশাপাশি নবীন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলেই এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন ফজলে রাব্বী মিয়া। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদ করে। সেই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন তৎকালীন ছাত্রলীগ কর্মী ফজলে রাব্বী মিয়া। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর; ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি সেই সময় স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারী আর কিছু হতে পারে না। ফজলে রাব্বী মিয়াকে সন্তানতুল্য জামাতার লাশ কাঁধে বহন করতে হয়েছে। গতবছরের শুরুতে তাঁর বড় জামাতা হাসান ইকবাল শামীমের মৃত্যু হয়। সন্তান আজীবন বাবা-মায়ের কাছে শিশুই থেকে যায়। ৬১ বছর বয়সে জামাতার মৃত্যু শ্বশুর ফজলে রাব্বীকে মানসিকভাবে আঘাত করেছিল। তিনি জামাতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। সে ভিডিও সেইসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে যত শক্ত মনের মানুষই হোন, চোখের জল আটকে রাখা কঠিন হবে। এর আগে ২০২০ সালে স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের মৃত্যুও তাঁর মধ্যে বড় রকমের শূন্যতা তৈরি করেছিল।

৯ মাস আগে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রাক্কালে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা শেষে বেশ কয়েকবার দোয়া-মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন ফজলে রাব্বী মিয়া। স্পিকারের সভাপতিত্বে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সময় গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্যের জন্য নির্ধারিত আসনে বসতেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। এখনও যদি কেউ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে সেই মোনাজাত দেখেন তাহলে ইসলামের প্রতি তাঁর দরদ অনুধাবন করতে পারবেন।

পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিন ফজলে রাব্বী মিয়াকে নিয়ে আলোচনা হবে। সংসদের রীতি অনুযায়ী চলমান সংসদের কোনো সদস্যের মৃত্যু হলে তাঁর ওপর অধিবেশনের প্রথম দিন শোক প্রস্তাব এনে আলোচনার রেওয়াজ রয়েছে। সে আলোচনায় সংসদ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি-বিরোধী দলের সদস্যরা স্মৃতিচারণ করবেন। জগতের কী নিয়ম! এক বছর আগে যিনি প্রয়াত সদস্য বা সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত পরিচালনা করেছেন; আগামী অধিবেশনে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত করা হবে।

জাতীয় সংসদে তুলনামূলক আইনজ্ঞ ও তৃণমূলের রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শিল্পপতি ও পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে রাজনীতিতে আসা জনপ্রতিনিধি বাড়ছে। তারপরও হাতেগানো যে কয়েকজন আইন প্রণেতার কারণে এখনও সংসদ প্রাণবন্ত হয়, তাঁদের একজন ছিলেন ফজলে রাব্বী মিয়া। তাঁর এই চলে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ হবে না। তবে তিনি আমৃত্যু তরুণদের ঘিরে যে স্বপ্ন দেখতেন, হয়তো তরুণদের মধ্য থেকে বের হয়ে আসবে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব। নির্বাচনী এলাকার জনগণ, সহকর্মীদের পাশাপাশি বাবার মৃত্যুতে শোকে কাতর ৩ কন্যা। 'যে যায় সে চলে যায়/ যারা আছে তারাই জেনেছে/ দু'হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়।' স্বজনদের সমবেদনা; কর্ম আর মানুষের ভালোবাসায় অমর হয়ে থাকবেন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ফজলে রাব্বী মিয়া।

লেখক: সাংবাদিক