মুদ্রা এমন এক বস্তু বা সম্পদ, যা সবার কাছে আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্য সব বস্তু বা সম্পদের তুলনায় এর চাহিদা ব্যাপক। কারণ হলো, বিনিময়ের মাধ্যম, সঞ্চয়ের বাহন, মূল্যের পরিমাপক এবং ঋণের কাজ-কারবারে এর ভূমিকা যথেষ্ট।
দুনিয়াজুড়ে এক সময় এমন এক অর্থনীতি ছিল, যখন বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। তখন কেবল দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্যই পাওয়া যেত। অর্থনীতির পরিভাষায় সেটিকে 'বার্টার সিস্টেম' বা দ্রব্য বিনিময় প্রথা বলে। এটি ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে একেবারে গোড়ার দিকের কথা। কালের আবর্তে এবং মানব সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে (যেমন গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা ইত্যাদি) বিনিময় প্রথায় অগ্রগতি সাধিত হয়। বিশেষত, পৃথিবীতে ইসলামের আবির্ভাবের পর বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্থান দখল করল মুদ্রা। কোনো কোনো বর্ণনায় ইসলাম-পূর্বকালেও মুদ্রার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কোরআনে বর্ণিত আসহাবে কাহাফের ঘটনায় সাত পুণ্যবান ব্যক্তি গুহা থেকে বেরিয়ে শহরে এসে দেখলেন, গুহায় রক্ষিত তাঁদের মুদ্রাগুলো বাজারে অচল হয়ে গেছে। বাজারের মানুষ তাঁদের হাতে রক্ষিত মুদ্রা দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন- মুদ্রার ধারক সাত ওলি অনেককাল আগের মানুষ।
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে টাকশাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তাতে সোনা-রুপার বিভিন্ন মুদ্রা তৈরি হতো। মারকাজি লিখেছেন, ইসলামী যুগে হজরত ওমরই (রা.) সর্বপ্রথম সোনা-রুপার টুকরোকে গোলাকার মুদ্রায় রূপান্তর করেন। ৪০ হিজরিতে হজরত আলি (রা.) সর্বপ্রথম বসরায় রৌপ্যমুদ্রা তৈরির জন্য টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আরও উন্নত সংস্করণের মাধ্যমে খলিফা আবদুল মালিকের আমলে টাকশালে তৈরি মুদ্রা 'দিরহাম' বিভিন্ন দেশে প্রচলিত হয়। স্বর্ণ-রৌপ্যের সীমিত জোগান ও ব্যাপক চাহিদা থাকায় কালের আবর্তে সে মুদ্রার স্থান দখল করল কাগজের নোট। কাগজের নোট প্রচলন ও ব্যবহার নিয়ে ভারতবর্ষ ও বিভিন্ন দেশের আলেম সমাজে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। পরিশেষে অনেক গবেষণার পর ফিকহ শাস্ত্রবিদরা ফতোয়া দেন, কাগজের নোট ব্যবহার বৈধ।
বাংলাদেশে এক সময় বিহিত মুদ্রা (লিগ্যাল টেন্ডার) হিসেবে ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা বা সিকি, ৫০ পয়সা বা আধুলি প্রচলিত ছিল। ধীরে ধীরে সেগুলো ১ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা ইত্যাদিতে রূপান্তর হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুদ্রা অনেকটা খেজুর দানার মতো ছিল। হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে মুদ্রার মনোগ্রাম হিসেবে কোনোটিতে 'আলহামদুলিল্লাহ', কোনোটিতে 'মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ' ইত্যাদি শব্দ প্রচলিত ছিল। আল্লাহর কালাম ও কালেমাখচিত মনোগ্রাম এক সময় ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলের মুদ্রাতেও ছিল। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ১০ টাকার নোটেও আতিয়া জামে মসজিদের ছবি ছিল। কালের আবর্তনে মনোগ্রাম হিসেবে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন প্রাণী, জীবজন্তুর ছবি ও ভাস্কর্য। কোনো কোনো নোটে রাজা-বাদশাহ, নেতা-নেত্রীর ছবিও স্থান পেয়েছে।
মুদ্রার পরিবর্তে নোটের ব্যবহারে দুর্নীতির মাত্রাও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অসাধুচক্রের কারসাজিতে বাজারে আসল নোটের পরিবর্তে জাল নোটের ছড়াছড়িও লক্ষ্য করা যায়। মুদ্রা ব্যবস্থায় এ কারসাজির মাত্রা একেবারেই সীমিত। ইমাম কুরতুবি (রহ.) তাঁর তাফসিরে কুরতুবিতে মাদ্‌ইয়ানবাসীর মুদ্রা জালকরণের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। মাদ্‌ইয়ানবাসী প্রচলিত স্বর্ণ ও রুপার পাশ থেকে একাংশ কেটে রেখে সেগুলো বাজারে চালিয়ে দিত। হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের এ কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। কোরআন মজিদে ওই কাজকে 'মারাত্মক দুস্কৃতি' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমাদের প্রিয় নবী (সা.) রাষ্ট্রের মুদ্রা ভঙ্গ বা ধ্বংস করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। কাজেই যারা টাকার নোট জাল করে, নোট ছিঁড়ে ফেলে, কালি বা রং দিয়ে নোটের বিকৃতি সাধন করে কিংবা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করে; ইসলামের দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের (রহ.) খেলাফতকালে এক ব্যক্তিকে দিরহাম কর্তনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। খলিফা তাকে দোররা মারা ও মস্তক মুণ্ডন করে শহরে প্রদক্ষিণ করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন (কুরতুবি)। কাজেই কাগুজে নোটের জালকরণ, বিকৃতিকরণ রোধে ইসলামী মূল্যবোধ ও সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন: সাবেক শিক্ষক; ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক