
রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম! শৈশবে এই ছড়া কাটতে কাটতে রেলগাড়ি সম্পর্কে যে ধারণাটি মাথায় ঢুকেছিল, তা যেন সাম্প্রতিক সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে- 'রেলগাড়ি ঝমাঝম, ভাড়া বেশি সেবা কম'।
কয়েক বছর আগের কথা। রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিল জনাকয়েক। সেখানে এক তরুণের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখেছিলাম শিরোনামের বাক্যটি। সেই নাম না-জানা তরুণের কথা আবার মনে পড়ল রেলের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবের বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত খবর পড়ে। ঘাটতি কমাতে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি, অতিরিক্ত দামে তাৎক্ষণিক টিকিটের ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবশ্য প্রকাশিত খবরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলেও যাত্রীসেবা বৃদ্ধির কোনো সুপারিশ খুঁজে পেলাম না।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাহেবরা প্রথম রেলগাড়ি চালু করেছিল। একটা সময়ে রেলগাড়ি ও রেলপথ ছিল রোমাঞ্চকর এক বিস্ময়। আমাদের গল্প-উপন্যাসে রেল এসেছে দারুণ রোমান্টিকতায়। এই শ্রাবণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। রেল নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে রোমান্টিক কবিতাটির রচয়িতা তিনি- 'রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,/ ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন। আগে ওকে বার বার দেখেছি/ লালরঙের শাড়িতে/ ডালিম ফুলের মতো রাঙা;/ আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,/ আঁচল তুলেছে মাথায়...।' ('হঠাৎ দেখা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
এই যে রেল নিয়ে এত সৃষ্টিমুখরতা; এসবই আজকের কমলাপুরে দাঁড়িয়ে ম্লান হয়ে যায়। যখন দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন আসে না। গন্তব্যে পৌঁছানো নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন রেলগাড়ি দেখলে সেই রোমান্টিকতা আর আসে?
পুরোনো দিনের সিনেমায় দেখা কুউ-উ-উ করে তীব্র হুইসেল আর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছুটে চলা কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন থেকে আমরা চলে এসেছি আধুনিক ইলেকট্রিক ট্রেনের যুগে। ইলেকট্রিক ট্রেনের কথায় আপনাদের কপালে ভাঁজ দেখা দিলে একটু থামুন। মনে করিয়ে দিচ্ছি, এই বাংলাদেশেই বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এটা কেবল এ দেশেই সম্ভব। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে যে দেশে সরকারি অর্থ লাগামহীন খরচ হতে পারে, সেখানে ঘাটতি কমাতে সেবার মান না বাড়িয়ে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব আসতে পারে বৈ কি!
১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত এ দেশে রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এর পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতারও ৫০ বছর পার করেছি আমরা। কিন্তু রেলপথে কিছু ক্ষেত্রে যোগ-বিয়োগ ছাড়া তেমন উন্নতি হয়নি। ২০১৯ সালের হিসাবে রেলপথের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রা শেষে রেলপথের দিকে তাকালে এ কথা মনে আসা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি হবে না যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই রেলপথকে অগ্রাধিকারে রাখেননি। যেন যোগাযোগ ব্যবস্থার সব উন্নয়ন সড়কপথেই নিহিত। তাই তো সড়ক নির্মাণেই আমাদের তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ বেশি মেলে। এখানে তাদের কোনো ফন্দি আছে কিনা, খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না আমাদের দায়িত্বশীলরা।
বাস্তবে সড়কপথ তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই বিনিয়োগকারী দেশ বা সংস্থার মাধ্যমে আসতে শুরু করে সড়ক নির্মাণের সামগ্রী থেকে গাড়ি ও যন্ত্রাংশ। দেখা যায়, কোনো দেশ যদি দেশের একটি সড়ক নির্মাণে অর্থ লগ্নি করে, সেই দেশ থেকেই আবার সড়কে চলাচলের গাড়িটিও আমদানি করা হয়। আবার বছর বছর সেই সড়ক নিজেদের অর্থে সংস্কার করতে হয়। সড়কে চলে যে গাড়ি, সে গাড়ির আয়ু ফুরিয়ে যায় বছরপাঁচেক পর। সেই তুলনায় রেলপথ নির্মাণে বিনিয়োগ অতি সাম্প্রতিক, অতি সামান্য।
অথচ টেকসই রেলপথ ও রেল ইঞ্জিন, বগি অনায়াসে এক যুগ চলে যায় বড় ধরনের সংস্কার ছাড়াই। তাই শুধু এসব উন্নয়ন সহযোগীকে খুশি করতে রেলপথে বিনিয়োগ না করে সরকারও সড়কপথে ভরসা রাখে। তখনই দেশের বৃহত্তর অংশ দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবেই বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথ বিশেষ অবহেলার শিকার হয়ে আসছে।
একটা সময়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই রেল ছিল। এখন তা আলাদা হয়েছে। একটি আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়ার পরে আশা করা হয়েছিল, রেলযাত্রায় এবার স্বস্তি মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, আদতে রেলের সেবা বাড়েনি। যা হয়েছে বেশকিছু মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান; বৈধ-অবৈধ নানা পন্থায়। আসল যে উদ্দেশ্য যাত্রীসেবা; সেটি থেকে গেছে অধরা। বরং যে কোনো উৎসবের সময় রেলের ভোগান্তি বহুগুণে ফিরে আসে। টিকিটপ্রাপ্তি থেকে শুরু হয় এই অনিয়ম ও ভোগান্তি। তারপর অতিরিক্ত দামে টিকিট কেনা, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন না ছাড়া, ট্রেন-কর্মীদের অপেশাদার আচরণ, যাত্রাপথ অরক্ষিতসহ নানা বিপত্তি তো আছেই।
এখন ঘাটতি কমানোর কথা শুনিয়ে ভাড়া বৃদ্ধির যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। রেলকে জনবান্ধব গণপরিবহন প্রমাণে আগে নজর দিতে হবে সেবার দিকে। রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কাহিনি প্রায়ই বের হয়। সেসব বন্ধ করা গেলে আর্থিক লোকসানও নিঃসন্দেহে কমে আসবে।
রেলওয়ের কালো বিড়ালের গল্প সবারই জানা। এখন ভাড়া বৃদ্ধির আওয়াজে সাড়া দিয়ে নতুন কালো বিড়ালের থলে বৃদ্ধিতে সহায়তা করা যাবে না। আর তা যদি হয় তবে আরও বহু প্ল্যাকার্ড হয়তো আমাদের দেখতে হবে। যাতে লেখা থাকবে- রেলগাড়ি ঝমাঝম, ভাড়া বেশি সেবা কম!
এহ্সান মাহমুদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক, সমকালের সহ-সম্পাদক
কয়েক বছর আগের কথা। রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিল জনাকয়েক। সেখানে এক তরুণের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখেছিলাম শিরোনামের বাক্যটি। সেই নাম না-জানা তরুণের কথা আবার মনে পড়ল রেলের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবের বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত খবর পড়ে। ঘাটতি কমাতে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি, অতিরিক্ত দামে তাৎক্ষণিক টিকিটের ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবশ্য প্রকাশিত খবরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকলেও যাত্রীসেবা বৃদ্ধির কোনো সুপারিশ খুঁজে পেলাম না।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাহেবরা প্রথম রেলগাড়ি চালু করেছিল। একটা সময়ে রেলগাড়ি ও রেলপথ ছিল রোমাঞ্চকর এক বিস্ময়। আমাদের গল্প-উপন্যাসে রেল এসেছে দারুণ রোমান্টিকতায়। এই শ্রাবণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। রেল নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে রোমান্টিক কবিতাটির রচয়িতা তিনি- 'রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,/ ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন। আগে ওকে বার বার দেখেছি/ লালরঙের শাড়িতে/ ডালিম ফুলের মতো রাঙা;/ আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,/ আঁচল তুলেছে মাথায়...।' ('হঠাৎ দেখা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
এই যে রেল নিয়ে এত সৃষ্টিমুখরতা; এসবই আজকের কমলাপুরে দাঁড়িয়ে ম্লান হয়ে যায়। যখন দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন আসে না। গন্তব্যে পৌঁছানো নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন রেলগাড়ি দেখলে সেই রোমান্টিকতা আর আসে?
পুরোনো দিনের সিনেমায় দেখা কুউ-উ-উ করে তীব্র হুইসেল আর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছুটে চলা কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন থেকে আমরা চলে এসেছি আধুনিক ইলেকট্রিক ট্রেনের যুগে। ইলেকট্রিক ট্রেনের কথায় আপনাদের কপালে ভাঁজ দেখা দিলে একটু থামুন। মনে করিয়ে দিচ্ছি, এই বাংলাদেশেই বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এটা কেবল এ দেশেই সম্ভব। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে যে দেশে সরকারি অর্থ লাগামহীন খরচ হতে পারে, সেখানে ঘাটতি কমাতে সেবার মান না বাড়িয়ে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব আসতে পারে বৈ কি!
১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত এ দেশে রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এর পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতারও ৫০ বছর পার করেছি আমরা। কিন্তু রেলপথে কিছু ক্ষেত্রে যোগ-বিয়োগ ছাড়া তেমন উন্নতি হয়নি। ২০১৯ সালের হিসাবে রেলপথের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রা শেষে রেলপথের দিকে তাকালে এ কথা মনে আসা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি হবে না যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই রেলপথকে অগ্রাধিকারে রাখেননি। যেন যোগাযোগ ব্যবস্থার সব উন্নয়ন সড়কপথেই নিহিত। তাই তো সড়ক নির্মাণেই আমাদের তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ বেশি মেলে। এখানে তাদের কোনো ফন্দি আছে কিনা, খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না আমাদের দায়িত্বশীলরা।
বাস্তবে সড়কপথ তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই বিনিয়োগকারী দেশ বা সংস্থার মাধ্যমে আসতে শুরু করে সড়ক নির্মাণের সামগ্রী থেকে গাড়ি ও যন্ত্রাংশ। দেখা যায়, কোনো দেশ যদি দেশের একটি সড়ক নির্মাণে অর্থ লগ্নি করে, সেই দেশ থেকেই আবার সড়কে চলাচলের গাড়িটিও আমদানি করা হয়। আবার বছর বছর সেই সড়ক নিজেদের অর্থে সংস্কার করতে হয়। সড়কে চলে যে গাড়ি, সে গাড়ির আয়ু ফুরিয়ে যায় বছরপাঁচেক পর। সেই তুলনায় রেলপথ নির্মাণে বিনিয়োগ অতি সাম্প্রতিক, অতি সামান্য।
অথচ টেকসই রেলপথ ও রেল ইঞ্জিন, বগি অনায়াসে এক যুগ চলে যায় বড় ধরনের সংস্কার ছাড়াই। তাই শুধু এসব উন্নয়ন সহযোগীকে খুশি করতে রেলপথে বিনিয়োগ না করে সরকারও সড়কপথে ভরসা রাখে। তখনই দেশের বৃহত্তর অংশ দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবেই বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথ বিশেষ অবহেলার শিকার হয়ে আসছে।
একটা সময়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই রেল ছিল। এখন তা আলাদা হয়েছে। একটি আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়ার পরে আশা করা হয়েছিল, রেলযাত্রায় এবার স্বস্তি মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, আদতে রেলের সেবা বাড়েনি। যা হয়েছে বেশকিছু মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান; বৈধ-অবৈধ নানা পন্থায়। আসল যে উদ্দেশ্য যাত্রীসেবা; সেটি থেকে গেছে অধরা। বরং যে কোনো উৎসবের সময় রেলের ভোগান্তি বহুগুণে ফিরে আসে। টিকিটপ্রাপ্তি থেকে শুরু হয় এই অনিয়ম ও ভোগান্তি। তারপর অতিরিক্ত দামে টিকিট কেনা, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন না ছাড়া, ট্রেন-কর্মীদের অপেশাদার আচরণ, যাত্রাপথ অরক্ষিতসহ নানা বিপত্তি তো আছেই।
এখন ঘাটতি কমানোর কথা শুনিয়ে ভাড়া বৃদ্ধির যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। রেলকে জনবান্ধব গণপরিবহন প্রমাণে আগে নজর দিতে হবে সেবার দিকে। রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কাহিনি প্রায়ই বের হয়। সেসব বন্ধ করা গেলে আর্থিক লোকসানও নিঃসন্দেহে কমে আসবে।
রেলওয়ের কালো বিড়ালের গল্প সবারই জানা। এখন ভাড়া বৃদ্ধির আওয়াজে সাড়া দিয়ে নতুন কালো বিড়ালের থলে বৃদ্ধিতে সহায়তা করা যাবে না। আর তা যদি হয় তবে আরও বহু প্ল্যাকার্ড হয়তো আমাদের দেখতে হবে। যাতে লেখা থাকবে- রেলগাড়ি ঝমাঝম, ভাড়া বেশি সেবা কম!
এহ্সান মাহমুদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক, সমকালের সহ-সম্পাদক
মন্তব্য করুন