
করোনার অতিমারি সামলে বিশ্ব অর্থনীতি আড়মোড়া ভেঙে উঠছিল সবে, ছক সাজাচ্ছিল থমকে যাওয়া বাজারে গতি ফেরাতে। কিন্তু হলো না। ইউক্রেন-রাশিয়া সমস্যা শুরুতে সুঁই হিসেবে দেখা দিলেও, সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে ফালের মতো। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি কিংবা খাদ্য সরবরাহের স্বাভাবিক গতিতে ছন্দপতন ঘটাল এই যুদ্ধ। ভেঙে পড়তে শুরু করল অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা। রাশিয়ার অর্থনীতিকে চেপে ধরতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিই চাপে পড়ে গেছে এরই মধ্যে। রয়টার্সের এক রিপোর্ট অনুসারে, ২৩ দশমিক ৫০ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন মুলুকে ক্রেতা কর্তৃক ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। অর্থাৎ মার্কিন অর্থনীতিতে তারল্য প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। বিপরীতে ফেডারেল রিজার্ভ বেসামাল মূল্যস্টম্ফীতি সামলাতে বাড়িয়েছে সুদের হার। ইউরোপের অর্থনীতি আছে আরও মারাত্মক চাপে। কারণ রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে জ্বালানি নিয়ে 'খেলছে' নিজের অর্থনীতির স্বার্থে। সেই সঙ্গে 'বিশ্বের রুটির ঝুড়ি' ইউক্রেন থেকে রপ্তানি করা যাচ্ছে না অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য। সংক্ষেপে এই যখন বড় অর্থনীতির দেশগুলোর হালচাল, তখন শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির বিশ্নেষণ শেষ করতে না-করতেই পাকিস্তানের অর্থনীতির নাভিশ্বাস দেখে চিন্তার বলিরেখা আরও খানিক প্রশস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো 'মধ্যম আয়ের দেশ'গুলোতে।
এবারের বাজেট অনুযায়ী, ঘাটতি বাজেটের একটি বড় অংশ আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রাইভেট সেক্টরের অর্থায়ন একটা বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। কারণ ঘাটতি বাজেট মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল অর্থ এই খাতে প্রবাহিত হবে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে এবং বিনিয়োগের জন্য ঋণের চাহিদার বিপরীতে জোগানকে ঘাটতিতে ফেলবে। আবার ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার যে ঋণ সংগ্রহ করবে, সেটির জন্য গুনতে হবে উচ্চ সুদহার। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রস্তাবিত উচ্চাভিলাষী আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণ মানুষের করের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়ার সুনির্দিষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং অতিরিক্ত করের বোঝা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থসামাজিক অবস্থাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে অনুমান করা যায়। সরকার করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকাতেই সীমাবদ্ধ রাখলেও, তৃতীয়বারের মতো কোম্পানি কর হ্রাস করেছে। আগের ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে এবার ২০ শতাংশ কর প্রস্তাব করা হয়েছে। বেসরকারি খাত কয়েক বছর ধরে করপোরেট করহার কমানোর দাবি করে আসছিল। যুক্তি ছিল, ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের নামে অতিরিক্ত শুল্ক্ক আরোপ করা হবে। ফলে এখনই এটিকে সমন্বয়ের ব্যবস্থা না করলে পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত চাপ ফেলতে পারে করপোরেট সেক্টরে। করপোরেট কর হ্রাস প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করবে এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হবেন বলে মাননীয় মন্ত্রী প্রত্যাশা করেছেন।
অন্যদিকে পোশাক শিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্পে ১২ শতাংশ কর বহাল আছে। যা রপ্তানি বহুমুখীকরণে পরিবেশবান্ধব পোশাক শিল্পের জন্য ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের পরিবেশবান্ধব কাঁচামাল, উৎপাদন ব্যবস্থা, কারখানার পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধী প্রযুক্তি, কারখানার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ক্রেতার ফরমাস প্রাপ্তিতে ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে উদ্ভূত বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মুক্ত বাণিজ্য, শিল্পকলকারখানার ব্যাপক সম্প্রসারণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য বহুমুখীকরণসহ অন্যান্য মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পরিবেশ দূষণ ক্রমে বেড়েই চলেছে, যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে ব্যাপক এবং অকল্পনীয় ক্ষতির সম্মুখীন করবে। উৎপাদনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দায় এড়াতে পারে না। বলা বাহুল্য, অসাবধানী উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এই ঝুঁকি অভিযোজন ও প্রশমনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল। যা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে কাজ করছে। পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানার জন্য হ্রাসকৃত কর নিঃসন্দেহে সরকারের এই প্রয়াসে ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা রয়েছে। প্রস্তাবিত কর হ্রাসের উদ্যোগ পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরিতে নিশ্চয়ই শিল্প মালিকদের প্রণোদনা জোগাবে। এ ছাড়া করপোরেট কর হ্রাস মুনাফা স্থানান্তরকে নিরুৎসাহিত করবে এবং নতুন মূলধনি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে। যা বাড়াবে উৎপাদনশীলতা, কর্মসংস্থান ও মজুরি।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই হতাশাজনক। সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, এই অনুপাত ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশের মতো। কিন্তু অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে গেলে এই অনুপাতকে বাড়াতেই হবে। উন্নত বিশ্বে এই কর জিডিপি অনুপাত প্রায় ৩৬ শতাংশ। আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপাল ও ভারতে এই অনুপাত যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৩০ ও ২০ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী অনেকটা হতাশার সুরেই সংসদে উল্লেখ করেছেন, চার কোটি টিন ধারী মানুষের মধ্যে মাত্র ৭৫ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের রিটার্নের অবস্থা আরও তথৈবচ! ব্যক্তিশ্রেণি কর দেয়ায় আগ্রহ পায় না। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা সুরক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা কম। তাঁর করের টাকায় সামাজিক কিংবা সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটবে- এমন আত্মবিশ্বাস সাধারণ মানুষের মনে এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। ফলে শুধু আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কর প্রদানে উৎসাহিত করা যাবে- এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। রাষ্ট্রের বরাদ্দ কিংবা কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান সুফল যতদিন সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারবে ততদিন স্বতঃপ্রণোদিত কর প্রদানে তাঁরা নিরুৎসাহিত থাকবেন বলেই ধারণা করা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের অর্থনীতির গতিপথ আমাদের চিন্তায় ফেলছে বলে যে সুস্পষ্ট গুঞ্জন শোনা যায় বাজারে, সেটিকে বিবেচনায় নিয়েই বাজেট বাস্তবায়নে হাত দেয়া উচিত বলে মনে করি। কেননা আমাদের এই প্রিয় দেশটিও অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভর। আমাদেরও আছে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ঘাটতি। আছে ক্যাপিটাল লিফটিং। মূল্যস্টম্ফীতি বাড়ছে লাগামহীনভাবে এবং সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মারাত্মক অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভয়ংকর শঙ্কা পিছু ছেড়েছে বলা যাবে না। কেননা উল্লিখিত ফ্যাক্টরের মধ্যে অন্যতম ক্যাপিটাল লিফটিং বন্ধ করার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমরা এখনও দেখতে পাইনি। সেই সঙ্গে অন্যান্য অনুঘটকেরও সহসা সমাধান হয়ে যাবে- এমন সম্ভাবনা নেই।
মন্তব্য করুন