আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ১৪ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সর্বশেষ 'উপহার' জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। এখন বাংলাদেশের মানুষ সামনে আতঙ্কের মাঝে আর্তচিৎকার দিতে পারে- শ্রীলঙ্কা আর কতদূর! অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী মেগা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে 'উন্নয়নের শ্রীলঙ্কা মডেল' এ দেশে বাস্তবায়নের যে প্রচেষ্টা গত এক যুগ ধরে চলেছে; তার চূড়ান্ত পরিণতি তো এমনই হওয়ার কথা ছিল।

জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির এই অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তে হতভম্ব দেশবাসী স্বাভাবিক কারণেই প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চাচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন- 'জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের লোডশেডিং, পানির দাম বেড়েছে, তেল-চাল-ডালের দাম বেড়েছে। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।' (সমকাল, ১২ আগস্ট, ২০২২)।

বস্তুত, এই জ্বালানি তেলের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সব ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার কঠিন করে তুলেছে। সড়ক পরিবহনের সিটি সার্ভিসগুলোর ভাড়া সরকার ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করলেও বাস্তবে বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি। এটা সিটি সার্ভিসের মালিকরা কথিত ওয়েবিলের নামে করেছে। সরকার ওয়েবিল প্রথা বাতিল করে নির্ধারিত ভাড়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে যাত্রীসাধারণকে নগর পরিবহনে চড়তে গিয়ে উচ্চ হারেই ভাড়া গুনতে হচ্ছে। আর তা মিটাতে গিয়ে মানুষকে তার মাসিক বাজেটের অন্য খাতগুলোতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সরকারের একই উদাসীনতা এবং তার দলীয় মালিক তোষণের কারণে নৌপরিবহনেও চলছে এ রকমই নৈরাজ্য। সরকারের সঙ্গে সভা করে লঞ্চ মালিকরা ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি করেছে। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো, সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় না থেকে ওই মালিকরা নিজেরাই সব নৌপরিবহনের ভাড়া ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে রেলপথ কর্তৃপক্ষও রেলের ভাড়া বৃদ্ধির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। অচিরেই হয়তো তা ঘোষিত হবে। বলে রাখা দরকার, সরকার গত নভেম্বরেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল। তখনও রেল বাদে সব ধরনের পরিবহনের ভাড়া এক দফা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অর্থাৎ এবারের পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির ফলে জনসাধারণকে মাত্র ৯ মাসে ৮০-৯০ শতাংশ বর্ধিত পরিবহন ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ অবস্থা ঘটেছে যখন অকল্পনীয় বাজার-মূল্যবৃদ্ধির কশাঘাত জনগণকে নিদারুণ অর্থ সংকটে ফেলেছে। কৃষি উৎপাদন, শিল্প-উৎপাদন ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়ে জাতীয় পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করতে চলেছে। যেসব নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নিজস্ব যন্ত্র-যানবাহন ব্যবহারে অভ্যস্ত, তারাও নিদারুণ জ্বালানি সংকটে ভুগবে।

পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক এবং 'লৌহমানব' নামে খ্যাত আইউব খান ১৯৫৮ থেকে '৬৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে থাকার পর 'উন্নয়নের দশক' পালন করেছিলেন বহু অর্থের অপচয় ও নানা আনুষ্ঠানিকতার মহোৎসব করে। সেই উন্নয়নের গালগল্পে বিশ্বাস না করে পাকিস্তানের মানুষ তখন গণতন্ত্রের জন্য তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিশেষভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রবল বিকাশ ঘটেছিল। বর্তমান বাংলাদেশে ১৪ বছর যাবৎ ক্ষমতা ধরে রাখার সরকারের মধ্যেও তথাকথিত 'উন্নয়ন-মহোৎসব' পালনের আইয়ুবি মানসিকতার উপস্থিতি দেখতে পাই আমরা।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ওঠা বিশাল ও নজিরবিহীন ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতন হয়। পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকচক্রের হাত থেকে আমাদের চূড়ান্ত মুক্তিও মিলেছে '৭১ সালে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলার মাঠ-ঘাট, নদী-প্রান্তর, ঘরবাড়ি রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া; ৩০ লাখ বাঙালিকে গণহত্যা আর আড়াই লাখ থেকে ৬ লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমহানির নজিরবিহীন আত্মত্যাগের লড়াইয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আজও প্রকৃত গণতন্ত্র পায়নি। গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রথম গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে এসেছিলেন। তার পরে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভয়ংকর স্বৈরাচারীরূপে আবির্ভূত হয়ে আশির দশকের প্রায় পুরোটা দেশের মানুষ, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির ওপরে জুলুম চালিয়ে গেছেন। প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে জেল-জুলুম-রক্তপাত সহ্য করে এই স্বৈরাচারী এরশাদকে নব্বইয়ের ডিসেম্বরে উৎখাত করে দেশের গণমানুষ। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দুটি গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক জোট। তার পরও গণতন্ত্র চলতে চলতে বারবার হোঁচট খেয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে পুরো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়ে দেশ পুরো দুই বছরের জন্য। এর পরে আসে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাল। গণতন্ত্রের নামে জালিয়াতির নির্বাচন; একের পর এক ভোটারবিহীন নির্বাচন; সর্বোপরি 'দিনের ভোট রাতে' সম্পাদনের মাধ্যমে দলটি এখনও শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অপচয় আর দুর্নীতি করতে করতে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। যদিও প্রথম থেকেই উন্নয়নের গান শোনানো হয়েছে; এখন প্রমাণ হয়েছে- সবই ছিল ফাঁপা বুলি।

এই যে সর্বশেষ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে জ্বালানি তেলের (পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন) গড়পড়তা ৪৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হলো; এটা সরকারকে করতে হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ-লাভের সম্ভাবনার কঠিন শর্ত মেনে চলতে গিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে- জনসাধারণকে কষ্ট দিয়ে এমন ঋণ নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

সরকার যদি জনবান্ধব, জনদরদি হতো; তাহলে নিজের জনগণকে কষ্ট দিয়ে আইএমএফের ঋণ নিতে যেত না। আমি মনে করি, এমন কঠিন শর্তে আইএমএফ বা অন্য কোনো বিশ্ব সংস্থার ঋণের দরকার নেই বাংলাদেশের। আমরা এমন ঋণের অর্থ কেন নিতে যাব, যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে চরম আর্থিক দুর্দশার পথে ঠেলে দিতে পারে এবং জাতীয় উৎপাদন মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত করে দিতে পারে?

খায়রুল কবীর খোকন: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব; সাবেক সংসদ সদস্য, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক