দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা শেখানোর নামে শিক্ষার্থীর 'করপোরাল পানিশমেন্ট' বা শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে সরকার এক যুগ আগে নির্দেশনা জারি করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি ওই নির্দেশনা যেন কেতাবেই রয়ে গেছে; বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। এ পরিস্থিতির সর্বশেষ পরিণতি আমরা দেখলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ইব্রাহিমিয়া তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে- পড়া না পারায় ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলীকে রোববার সকালে বেত্রাঘাত করেন হেফজ বিভাগের শিক্ষক হুসাইন আহমেদ। বিকেলে সেই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয় মাদ্রাসার বাথরুম থেকে।
স্বীকার করতেই হবে, অঘটনটি বেদনাদায়ক হলেও বিস্ময়কর নয়। মাদ্রাসায় শিক্ষকের বেদম প্রহারের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থী- এমন ঘটনা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের উপজীব্য হয়। কখনও কখনও প্রহারের কারণে শিশু শিক্ষার্থীর প্রাণহানিও ঘটতে দেখা যায়। শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; সাধারণ বিদ্যালয়েও এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ২০১৯ সালে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর ওপর চালানো একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপের আগের মাসে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনো শারীরিক শাস্তি ভোগ করেছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এ ধরনের কোনো প্রাণঘাতী নির্যাতনের খবর যখন সংবাদমাধ্যমে আসে, তখন এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সংশ্নিষ্ট শিক্ষককে গ্রেপ্তারে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা সময়ে যখন ওই আলোচনা থিতিয়ে আসে, তখন সংশ্নিষ্ট আক্রান্তের পরিবার ন্যায়বিচার পেল কিনা, তার খোঁজ কেউ রাখে না। শিশুর সঙ্গে এ ধরনের বর্বরতা অবসানের প্রয়াসও বন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের মনে আছে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করপোরাল পানিশমেন্টের কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এ ধরনের নির্যাতন বন্ধের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের শাস্তি নিষিদ্ধ করে নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন বিভিন্ন শিশু অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে শিশুর ওপর সব ধরনের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটা উপযুক্ত আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছিল। তাদের এই যুক্তি যথার্থ ছিল যে, এ ধরনের নির্দেশনায় শাস্তির বিষয়টি নির্দিষ্ট না থাকায় আদালতেও বিচারপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে। আমরাও মনে করি, একটা কার্যকর আইন থাকলে কথায় কথায় শিক্ষার্থীকে শারীরিক শাস্তি প্রদানের আগে সংশ্নিষ্টরা দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন। গত জানুয়ারিতে একটা ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক অধিকারকর্মীর নিবন্ধ থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত যে ৬৩টি দেশ পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যে কোনো স্থানে শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন তৈরি করেছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নেই। সরকার যে শুধু শিশুদের ওই বর্বরতা থেকে বাঁচাতে আইন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা নয়; এ ধরনের নির্যাতন বন্ধে ২০১০ সালে প্রদত্ত নির্দেশনাটির বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা হয়নি।
অস্বীকার করা যাবে না, শিশু 'মানুষ' করার এ জঘন্য পন্থা এক সময় সারাবিশ্বেই চালু ছিল। এখনও দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে এমন ধারণা প্রায় বদ্ধমূল- শিশুকে সঠিক আচরণ শেখাতে মাঝেমধ্যে দণ্ড দিতে হয়। কিন্তু এর ফলে কত সম্ভাবনাময় প্রাণ অকালে ঝরে যায়; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক প্রাণহানি তার সর্বশেষ প্রমাণ। বৈজ্ঞানিকভাবেও এটা প্রমাণিত- শারীরিক শাস্তি তো বটেই, একটু কর্কশ ধরনের মানসিক শাস্তিও অনেক শিশুর মনে নানা ধরনের নেতিবাচক ছাপ রেখে যায়। যার রেশ তাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এমন উদাহরণও আশপাশে বিরল নয়, মধ্যযুগীয় শাস্তির কারণে মানসিক বৈকল্যের শিকার শিশু শিক্ষাজীবনেরই ইতি ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। শৈশবে সহিংসতার শিকার অনেকেই পরবর্তী সময়ে সহিংসতা চর্চায় লিপ্ত হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা- শিশুদের সুস্থ-স্বাভাবিক পথে বেড়ে ওঠার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে সরকার উদ্যোগী হোক। তার আগে নিশ্চিত করুক শিক্ষার্থী নির্যাতনকারী শিক্ষকের বিচার।