
সোমবার রাজধানীর উত্তরায় উড়াল সড়ক-যাকে বিআরটি বা বাস র্যাপিড ট্রানজিট বলা হচ্ছে- বানাতে গিয়ে ক্রেন থেকে একটি গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হলো; চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লেগে ছয়জন শ্রমিকের অকাল মৃত্যু ঘটল এবং গুলিস্তানে হল মার্কেটের একটি ক্রেন থেকে রড পড়ে বেশ কয়েকজন পথচারী গুরুতর আহত হলেন। এভাবে প্রতিদিনই দেখছি সড়ক, নৌ, অগ্নি-দুর্ঘটনা ও বিল্ডিং ধসে শত শত লোকের মৃত্যু, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি ও পরিবেশের বিপর্যয়। এই দুর্ঘটনার হার প্রতিদিনই বাড়ছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য জোর দাবি জানাই, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য হৈচৈ করি। এই করলে সেই করলে দুর্ঘটনা রোধ হবে বলে চিৎকার করতে থাকি। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির জন্য সভা-সমাবেশ করি। কিছুদিন পর আবার আমরা হারিয়ে যাই। যে অবস্থায় ছিল আবার সেই অবস্থায় থাকে সবকিছু। নিয়ম থাকে কিতাবের পাতায়, পরিদর্শক থাকেন পরিদর্শকের জায়গায়, ব্যবস্থাপক থাকেন ব্যবস্থাপকের জায়গায়। আবার যা হওয়ার তাই হয়।
এভাবে আর কতদিন চলবে এই অব্যবস্থাপনা? এই অব্যবস্থাপনা কী একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না? আজ প্রতিটি জায়গায় দেখতে পাই অব্যবস্থাপনার স্বর্গরাজ্য। হোক সেই উড়াল সড়ক নির্মাণ, বহুতল ভবন নির্মাণ, কলকারখানা কিংবা যানবাহন চালানো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি নির্দিষ্ট কালচার থাকে। এই কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে প্রত্যেক ব্যবস্থাপক এবং প্রত্যেক ব্যক্তির আন্তরিকতা-নিষ্ঠার সঙ্গে ও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে কখনও পিছপা না হওয়া। এ কালচারের ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের সফলতা, গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি।
প্রতিষ্ঠানের কালচারের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে; তা হলো সেফটি কালচার। সেফটি কালচার হচ্ছে কতগুলো বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, যা সবাইকে লালন ও ধারণ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে সেফটি কালচার বিষয়ে বীজ বুনে দিতে হয় তাঁর প্রত্যেক ব্যবস্থাপক ও কর্মীর মাঝে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকের ভূমিকাই মুখ্য। প্রতিষ্ঠানের কালচার থেকেই সেফটি কালচার তৈরি হয়। মোদ্দা কথা, সেফটি কালচার হচ্ছে সব দুর্ঘটনা রোধের একমাত্র মূলমন্ত্র।
কোম্পানির উৎপাদন বাড়াতে, আর্থিকভাবে লাভজনক ও ব্র্যান্ডিং করতে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির ম্যানেজমেন্ট স্কুলের ইমেরিটাস অধ্যাপক ইগর সিচিন ১৯৮০ সালে অর্গানাইজেশন কালচার বিষয়ে একটি মডেল প্রণয়ন করেন। মডেলটির তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে হচ্ছে মানুষের ভেতরে লুক্কায়িত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা আর শেষ ধাপে হচ্ছে মানুষের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে অবলোকন করা। এটিকে আইসবার্গ থিওরি বলা হয়, অর্থাৎ মানুষের ৮০ শতাংশ বৈশিষ্ট্যই ভেতরে লুক্কায়িত থাকে আর ২০ শতাংশ বৈশিষ্ট্য আমরা কেবল দেখতে পাই। ইগর সিচিনের অর্গানাইজেশন কালচারই সব ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পড়ানো হয়। সেই অর্গানাইজেশন কালচার থেকেই আবার সেফটি কালচার তৈরি হয়েছে এবং এটিরও একইভাবে তিনটি ধাপ রয়েছে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর থেকে মূলত সেফটি কালচারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এখন সব জায়গায়ই সেফটি কালচারের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। সেফটি কালচার কোনো কারিগরি বিষয় নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। সেফটি কালচারের ওপর নির্ভর করছে প্রতিষ্ঠানের সেফটিবিষয়ক কার্যসম্পাদনের দক্ষতা ও সুরক্ষা।
বিষয়টির প্রবক্তাদের মতে, একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপককে প্রথমে সেফটি কালচার সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভ করতে হবে এবং সব কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। ব্যবস্থাপক নিজে তা চর্চার মাধ্যমে তাঁর অধীনস্থ কর্মীদেরও তা করতে উৎসাহী করে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সিদ্ধান্ত সেফটি নিশ্চিত করে কিনা তা বিবেচনায় নিয়ে করতে হবে এবং সেফটিকে দুর্বল করে এমন কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
তাহলে প্রতিষ্ঠানে সেফটি কালচার আছে কিনা তা বুঝব কেমন করে? দেখতে হবে, প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সভায় সেফটি-বিষয়ক আলোচ্যসূচি আছে কিনা, কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা, যন্ত্রপাতির সুবিধা, যন্ত্রপাতির সঠিকভাবে চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট, কমিটি গঠন, তাদের কার্যক্রম তদারকি, রীতিমতো প্রশিক্ষণ প্রদান করছে কিনা, মহড়া করছে কিনা ইত্যাদি। সেফটি কালচার জরিপ, সাক্ষাৎকার, কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণসহ চারটি পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করতে হয়। প্রতিটি পদ্ধতিতে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে প্রতিষ্ঠানের ভালো ও দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠবে সফল ও নামিদামি।
কালচার পালন শুধু যে কলকারখানার মালিকপক্ষই করবেন তা কিন্তু নয়। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকেও সমানভাবে তা পালন করতে হবে। উভয়ের ভূমিকাই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিশ্চিত করা মালিকপক্ষেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এখন এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে যদি আমাদের দেশের দিকে তাকাই তাহলে ফুটে উঠবে এক আতঙ্কজনক চিত্র।
আজ দেখতে পাই উড়াল সেতু, ভবন বা যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ কর্তৃপক্ষ কিংবা কলকারখানার কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতি মানার কোনো মনোবৃত্তি নেই। যে উড়াল সড়কের গার্ডার সোমবার খসে পড়ে ৫টি প্রাণ কেড়ে নিল তার ঠিকাদারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল; কিন্তু বলা হয়েছে, ঠিকাদার নাকি ওই পরামর্শককে তাঁর কর্মপরিকল্পনা জানাননি; তাহলে পরামর্শকের দরকার কী? যাঁর পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করার কথা সেই প্রকল্প পরিচালকই বা কী দায়িত্ব পালন করছিলেন? প্রকল্পটির চেয়ারম্যান হলেন সড়ক পরিবহন সচিব। সংশ্নিষ্টরা এখন দুর্ঘটনার পুরো দায় ঠিকাদারের ওপর চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চাচ্ছেন? এখানে সেফটি কালচার কার মধ্যে আছে?
আর কত দুর্ঘটনা আমরা দেখব? মৃত্যুর মিছিল দেখব? এসব দুর্ঘটনার শতকরা ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাঝে সেফটি কালচার বিদ্যমান থাকে। বাকি ২০ শতাংশ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। যন্ত্র যতই ভালো হোক না কেন, মানুষ যন্ত্রের প্রতি সংবেদনশীল না হলে ভালো যন্ত্র অকেজো হতে বেশি সময় লাগে না। কালচার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থকড়ির প্রয়োজন পড়ে না। দরকার শুধু মন-মানসিকতার পরিবর্তন, সঠিক পরিকল্পনা ও সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন। অবকাঠামো নির্মাণ, কলকারখানা, সড়কপথ ও নৌপথে সব প্রকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার মনে হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তরগুলো দিয়ে আর সম্ভব নয়। সময় এসেছে একটি পৃথক ও স্বাধীন নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কিংবা নিরাপত্তা কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।
সেফটি কালচারের অভাবে আমরা আর কোনো মায়ের বুক খালি হওয়া দেখতে চাই না, পরিবারের সারাজীবনের জন্য কান্না শুনতে চাই না। নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ নৌযান ও নিরাপদ কলকারখানা সর্বোপরি একটি নিরাপদ পরিবেশ দেখতে চাই।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম :অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
msislam@du.ac.bd
মন্তব্য করুন