রাজধানীর উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট তথা বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলাকালে সোমবার বিকেলে ভায়াডাক্টের একটি বক্স গার্ডার ক্রেন থেকে পড়ে প্রাইভেটকার আরোহী পাঁচজনের নিহত হওয়া যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই বিক্ষোভ জাগানিয়া। বেদনাদায়ক এই কারণে যে, বিয়ের আনন্দঘন পর্বগুলো চলাকালেই নতুন দম্পতি ও তাঁদের স্বজনরা এমন অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। আমাদের বিক্ষোভের কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্নিষ্টরা দায়িত্বশীল ও সতর্ক হলেই নাগরিকদের জন্য এই বেদনাদায়ক অধ্যায় এড়ানো সম্ভব ছিল। বস্তুত এই দুর্ঘটনা রাজধানীর মেগা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বহুমাত্রিক অবহেলা ও ঔদাসীন্যের উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের একজন সহকারী পরিচালকও সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, কমবেশি ৫০ টন ওজনের গার্ডারটির সরানোর মতো সরঞ্জাম তাঁদের কাছে নেই। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে ওই ওজন উত্তোলনে সক্ষম ক্রেন ঘটনাস্থলে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। হতাহতদের এক স্বজনের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত যে সময় মতো উদ্ধার কাজ শুরু করা গেলে নিহতদের জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হতো। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে সংঘটিত দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজ শুরু করতে যদি সাড়ে ৭টা বেজে যায়, তাহলে এই মর্মান্তিক প্রাণহানি কেবল অক্ষমতা নয়, অবহেলার অমার্জনীয় উদাহরণ হয়ে থাকতেও বাধ্য।
মেগা প্রকল্পটি নিয়ে এমন মেগা অবহেলার আরও প্রমাণ স্পষ্ট। সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- সোমবারের এই 'দুর্ঘটনা' বিআরটি প্রকল্প ঘিরে 'বিচ্ছিন্ন' ঘটনা নয়। দেশের ব্যস্ততম সড়কে প্রায় এক দশক ধরে চলা এই মেগা প্রকল্পে নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টি বলতে গেলে কখনোই গুরুত্ব পায়নি। এই চিত্র দেখে বিস্মিত হতে হয় যে- নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই সড়ক খুঁড়ে পাইলিং, পিয়ার ও ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সোমবার উত্তরায় যে স্থানে ক্রেন কাত হয়ে গার্ডারটি প্রাইভেটকারটির ওপর পড়েছিল, সেখানেও নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া একটি সিসিটিভি ফুটেজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, যানবাহন চলাচল বন্ধ না করেই গার্ডারটি ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছিল। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকার পরও গার্ডার তোলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চলাকালে যদি যান চলাচল বন্ধ রাখা হতো তাহলে সম্ভবত এই মর্মান্তিক প্রাণহানি দেখতে হতো না আমাদের। সোমবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বিআরটি প্রকল্পের কাজ 'আপাতত' বন্ধ থাকবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা 'আপাতত' সংগত। কিন্তু গোটা প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে যদি আবার কাজ শুরু করা হয়, তার চেয়ে অসংগত কাজ আর কিছু হতে পারে না।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি কোম্পানি বিআরটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদিও সমকালকে বলেছেন যে, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী কারিগরি ত্রুটির কারণেই ক্রেনটি কাত হয়ে গিয়েছিল; এই প্রশ্ন অনিবার্য যে নির্মাণকাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির কারিগরি দিক পরীক্ষা না করেই কাজ করা হচ্ছিল কেন? বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, উত্তরায় ব্যবহূত ক্রেনটির ওজন-সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে অবহেলার বিষয়টি আরও গুরুতর। 'সরকারি' কোম্পানি বলেই কী এভাবে 'গায়ের জোর' দেখিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এবং যান চলাচল বন্ধ না করেই এতবড় স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছিল? আরও উদ্বেগের বিষয়, বিআরটি প্রকল্পটিতে গত ১৭ মাসে আরও দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বিশেষত গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছিলেন। গত বছরের মার্চ মাসেও বিমানবন্দর স্টেশনের সামনে রোডওয়ে স্ল্যাব লঞ্চার ভেঙে দুই চীনা কর্মীসহ চারজন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তারপরও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে তৃতীয় দুর্ঘটনার জন্য 'অপেক্ষা' করা হচ্ছিল কেন? এর জবাবদিহি করতেই হবে। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই মামলা হয়েছে। শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীও দোষীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বিলম্বে হলেও শুধু বিআরটি নয়, মেগা প্রকল্প ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অবহেলা ও ঔদাসীন্য কাটিয়ে উঠতে না পারলে সোমবারের মতো এমনকি আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যাবে।