- মতামত
- মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে বিপরীত দিকে নিয়ে গেছে ১৫ আগস্ট : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সাক্ষাৎকার
মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে বিপরীত দিকে নিয়ে গেছে ১৫ আগস্ট : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হকিকত জাহান হকি
সমকাল :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা একটা বর্বর, নিষ্ঠুর ঘটনা। এটাকে শুধু ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড মনে করলে ভুল হবে। এটার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। মূলত আমাদের দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী ধারায় নিয়ে যাওয়াই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন; কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সুগভীর ষড়যন্ত্র। অনেক আগে থেকেই তারা ওঁৎ পেতে ছিল কীভাবে একাত্তরের বিজয়কে নস্যাৎ করা এবং দেশকে আবার পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে আনা যায়। স্বাধীনতাবিরোধীরা পরাজিত হয়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করা সত্ত্বেও তখনই তারা দেশের বিরুদ্ধে আকস্মিক পরিকল্পনা (কন্টিনজেন্সি প্ল্যান) করে রেখেছিল।
বঙ্গবন্ধু যাতে প্রগতির পথে দেশকে এগিয়ে নিতে না পারেন, সে জন্য তারা পদে পদে প্রতিবন্ধকতা, অন্তর্ঘাত, অরাজকতা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ইত্যাদির আশ্রয় নিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু আপস করেছিলেন। সে সময় তাঁর জনপ্রিয়তাও কমে গিয়েছিল। তিনি এবং বিশেষ করে তাঁর দল আওয়ামী লীগ এক পর্যায়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। চক্রান্তকারীদের জন্য সেটা সুযোগ করে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রেখে তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে পূরণ করা হয়তো সম্ভব হবে না। তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। শুধু তাই নয়; তাঁকে যে সম্পূর্ণ নির্বংশ করতে হবে- সেটাও তারা বুঝতে পেরেছিল। সে জন্যই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় তারা অগ্রসর হয়েছিল।
সমকাল :রাজনৈতিক নেতা ও শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সেলিম : বঙ্গবন্ধু আজীবন রাজনীতি করেছেন। তাঁর রাজনীতি ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। তবে তিনি একই সঙ্গে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভক্ত ও অনুরাগী ছিলেন। সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে অনেক সময় এই দ্বিমুখী চিন্তা তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ওই সময় তিনি এক ধরনের দোটানার মধ্যে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর দল আওয়ামী লীগের গণ্ডি এবং আওয়ামী লীগ তার বুর্জোয়া শ্রেণিভিত্তিকে অতিক্রম করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই দেশবাসী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনাকারী আন্দোলনের শক্তিগুলো তাঁকে কেন্দ্র করেই ঐক্য গড়ে তুলেছিল। সত্তরের নির্বাচনে তিনি বাঙালি জাতির একক নেতা হিসেবে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু শাসক হিসেবে তাঁর অনেক কৃতিত্ব থাকলেও নানা ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা এবং দোদুল্যমানতারও পরিচয় দিয়েছিলেন।
সমকাল :বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওই সময়ের আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
সেলিম :বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী শুধু হতচকিত ও ভীত হয়েই পড়েনি; তাদের একাংশ খুনি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। আরও বড় একটি অংশ মোশতাকের চিন্তার সঙ্গে সহমর্মী হয়ে উঠেছিল। অল্প কিছু নেতাকর্মী বাদে হত্যার প্রতিবাদে আর কেউ রাজপথে নামেননি। ওই সময় সরকারের সহযোগিতায় 'নব্য ধনিক শ্রেণি' গড়ে উঠেছিল। তারা সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল।
সমকাল :আওয়ামী লীগের অভিযোগ- সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত। পরে জিয়াউর রহমান এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পুনর্বাসন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কী বলবেন?
সেলিম :আমার আরও বড় অভিযোগ হলো- ঘাতকের বিচার করা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল, তা আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। এর সঙ্গে জড়িতদের আজও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। খুনি মোশতাকের নাম এ ক্ষেত্রে প্রথমে উচ্চারিত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাদের দুর্বলতা এবং অনীহা কেন?
সমকাল :১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে কতটুকু পিছিয়ে দিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম :এ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিপরীতমুখী ধারায় নিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছে। এই সময়ে আওয়ামী লীগ চারবার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা পঁচাত্তরের পর প্রবর্তিত প্রতিক্রিয়াশীল সেই 'মোশতাকি' ধারাকেই অব্যাহত রেখেছে এবং এক অর্থে সেটিকে দৃঢ়মূল করেছে।
মন্তব্য করুন