দশকের পর দশকজুড়ে অসহিষ্ণু, নির্মম ও সহিংস রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেতাকর্মীদের যে চা পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তা আমাদের নতুন যুগের সূচনা ভেবে আনন্দিত ও উৎসাহিত করেছিল। প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে বা বাগ্‌বিতণ্ডা ও পরস্পরের সমালোচনা থাকে। তবে আমাদের মতো অনেক দেশে পরস্পর বিরোধিতা সহিংস রূপ নেয়। এই সহিংসতার ভয়ংকর ও নৃশংস রূপ আমরা দেখেছি '৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াত এই বৈরিতাকে পেছনে ফেলে অসহিংস এবং আলাপ-আলোচনা ও বাগ্‌বিতণ্ডার রাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনালগ্ন হিসেবে সবাইকে আশান্বিত করেছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সবার আশা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। ইতোপূর্বে বিরোধী দলগুলোকে দমনে খলনায়কের ভূমিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবির্ভূত হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিরোধীদের জন্য সভা-সমাবেশে অনুমোদন না দেওয়া, মানববন্ধন ও মিছিলে লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস, এমনকি মাঝেমধ্যে গোলাগুলি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারভুক্ত বলে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

প্রধানমন্ত্রীর চায়ের নিমন্ত্রণের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের লাঠিপেটা ও মামলা দেওয়ার ভূমিকা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসবেন। হয়তো কিছুটা সরেও এসেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের সংবাদে এখন যেটা ঘনঘন দেখা যাচ্ছে, তাহলো সরকারি দল এবং তাদের সহযোগী অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো তারা বিরোধীদের মিটিং, মিছিল ও মানববন্ধন ভন্ডুল করার জন্য লাঠিসোটা হাতে অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যালয়, বাসস্থান, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও আক্রমণ করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপদল ও তাদের অনুসারীরাও একে অপরকে লাঠির আক্রমণে পরাস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আশঙ্কা হয়, সরকারি দলের নেতাকর্মীদের এভাবে তথাকথিত মাঠে নামার পরিণতি পুরো দেশের জন্যই ভীষণভাবে অমঙ্গলকর হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী সরকারের দেশে প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরে সরকারি দল, এরপর সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন বিরোধীদের শায়েস্তা করতে মাঠে নামে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হলো সরকারি দলের বিভিন্ন উপদল বা ভিন্ন ভিন্ন নেতাদের অনুসারীরা এবং তারপর অঙ্গসগংগঠনের বেলায়ও এই হানাহানি ছড়িয়ে পড়ে। আর তৃতীয় পর্যায়ে এই হানাহানি রাজনৈতিক দলগুলোর সীমনা ছাড়িয়ে যায়। এই তৃতীয় পর্যায়ে এসে সাধারণ জনগণ, যাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তারাও নির্বিচারে এসব হানাহানি, সহিংসতা, লুটপাট, চাঁদাবাজির শিকার হতে শুরু করেন। ততদিনে আইনের শাসন ভেঙে পড়ে, আদালতেরও খুব বেশি কিছু করার থাকে না। আর বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানও দুর্বৃত্তায়িত হয়ে যায়। তখন নিরাপত্তাহীনতা ও ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ জনগণ। এই তৃতীয় পর্যায়টা প্রথম দুই পর্যায়ের অনেকটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বা ফলাফল।

তৃতীয় পর্যায়টা বিভিন্ন দেশে চলেছে এক-দুই বছর, অথবা কোনো কোনো দেশে এক দশক বা এক যুগ। তবে এর শেষটা হয় চলমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে। আশা করি আমাদের এই দেশটা তৃতীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে অথাৎ রাজনীতিতে আলাপ-আলোচনা বা মতবিনিময় ফিরিয়ে আনবেন এবং যারা সহিংসতার আশ্রয় নেয় তাদের বিরত করবেন। বিরোধী দলেরও দায়িত্ব হলো এই মতামত বিনিময়ে আলাপ-আলোচনায় সক্রিয় অংশ নেওয়া এবং প্রতিটি ছুতায় সরকারকে উৎখাত করার হুমকি-ধমকি থেকে কিছু কালের জন্য হলেও বিরত থাকা।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী