বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় সারা পৃথিবী এখন 'গ্লোবাল ভিলেজ'-এ রূপান্তরিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সেখান থেকে বাদ যায়নি প্রাথমিক শিক্ষাও। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় এনেছে অনন্য বিবর্তন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির সংযোগ ও ব্যবহারে ছাত্রছাত্রীদের শিখন প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে যুগোপযোগী এবং কার্যকর। ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুত করে শিক্ষকরা মুক্তপাঠ, শিক্ষক বাতায়নের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সহায়তায় ক্লাস পরিচালনা করছেন। আধুনিক শিক্ষা তাই এখন আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাইজেশনের আশীর্বাদে আধুনিক শ্রেণি পাঠদান সম্ভব হয়েছে।

শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুই ধরনের জ্ঞান অর্জিত হয়, যা তাদের স্মৃতিতে দীর্ঘ সময় সংরক্ষিত থাকে। পাঠ্যপুস্তকনির্ভর মুখস্থ বিদ্যার চর্চা কমিয়ে প্রাথমিক স্তরেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চেতনার বিকাশে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। গতানুগতিক শ্রেণি পাঠদান একমুখী হওয়ায় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক জ্ঞান বিনিময় হয় না। অপর পক্ষে পাঠ্যবইয়ের বিষয়ভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত ছবি ও শব্দের মাধ্যমে আকর্ষণীয় উপস্থাপন, যা ডিজিটাল কনটেন্ট নামে পরিচিত সেটি অধিক কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এস্পায়ার টু ইনোভেট (পূর্বনাম এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রদান করা হয়, যার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ২৫০০০ মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ। এটি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আইসিটি বিষয়ে শিক্ষকদের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রসার ঘটিয়েছে। ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকদের আগমন, প্রস্থানে শৃঙ্খলা, পাঠদানে সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ২০৪১-এর উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটির ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এর সুফল পূর্ণ মাত্রায় পেতে হলে শিক্ষকদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদানসহ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাণ এবং তা ব্যবহার করে পাঠদানকে উৎসাহিত করতে হবে। অভিজ্ঞ, দক্ষ শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করতে পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুফল সর্বত্র দৃশ্যমান। করোনাকালীন বাস্তবতায় আমরা জুম অ্যাপ ব্যবহার করে সভা করেছি। 'হোম অফিস' নামক শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে। যেটি হয়তো কভিড-১৯ এর আগে আমরা ভাবতেও পারিনি। বৈশ্বিক মহামারির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্টম্ফীতি যখন বাড়তি চাপ নিয়ে এলো, তখন আমরা বিদ্যুৎ, জ্বালানি সাশ্রয় নিয়ে ভাবছি। প্রাত্যহিক ব্যয় সংকোচন করে মিতব্যয়ী হতে চেষ্টা করছি। চলমান বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি এক দিনের পরিবর্তে দুই দিন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

করোনাকালীন শিক্ষাক্ষেত্রে ঘাটতি মোকাবিলায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজিটাল টুলস ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এক প্রকার ডিজিটাল রূপান্তর দেখা গেছে। করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি পাঠদান সম্ভব না হওয়ায় প্রযুক্তির সহায়তায় ঘরে বসে শিক্ষা গ্রহণের নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গুগলমিট, জুম, অনলাইনে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পাঠদান করা হয়েছে। আমাদের ভাবার অবকাশ ছিল না যে, শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিজ নিজ বাড়িতে বসেও ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করতে পারে; আবার শিক্ষকরাও একইভাবে পাঠদান করতে পারেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করে পাঠদানে যদি শিক্ষকদের দক্ষ করা যায়, তাহলে আপৎকালেও পাঠদান অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। যদিও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিদ্যালয় পরিদর্শন করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের সংকট অনুভব করা যাচ্ছে। এ সংকট মোকাবিলায় প্রাথমিক স্তরে শিক্ষায় ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে পাঠদান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। লেখাপড়ায় দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততা কাটিয়ে মনোযোগের সঙ্গে আনন্দময় শিক্ষা এখন সময়ের দাবি। স্বনির্ভর জাতি গঠনে সরকার তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তানির্ভর শ্রেণি পাঠদানের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল লার্নিং জোরালোভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে।

সাদিয়া জেরিন: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
sadiyajarin@gmail.com