গত সপ্তাহে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের প্রাণকেন্দ্রে যে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে, তা হতাশাজনক হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। এক বছর ধরে সেখানে এক ধরনের উত্তেজনা আমরা দেখছি। দুই দশক ধরে যুদ্ধ এবং সহিংসতায় শক্তিশালী যে জাতিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে, সেখান থেকে যেন তাদের মুক্তি নেই। তবে বর্তমানে ইরাকে যে সংকট আমরা দেখছি; গত অক্টোবরের সংসদীয় নির্বাচনের পরপরই তার শুরু। ইরান সমর্থিত কিছু দল তাদের হারার কারণ হিসেবে আমেরিকা দ্বারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচন জালিয়াতিকে দোষারোপ করেছে। গত বছর অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনে মোকতাদা আল-সদরের রাজনৈতিক জোট বেশিরভাগ আসনে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন নিয়ে ইরানপন্থি শিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে সদরের এমপিরা পদত্যাগ করলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

এমনিতেই মোকতাদা আল-সদর ও তাঁর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল উভয়েরই সরকার গঠনের চেষ্টা বিফলে যাওয়ায় গত বছরজুড়ে ইরাকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। গত মাসে ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নূর-ই আল-মালিকির নেতৃত্বাধীন ইরানপন্থি শিয়া জোট যখন একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার চেষ্টা করে, তখন মোকতাদা আল-সদরের সমর্থকরা সংসদে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। পরে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাতে হস্তক্ষেপ করেন। এদিকে আল-সদর রাজনীতি ছেড়ে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। বিশেষ করে একটি অডিও ফাঁস হওয়ায় ইরাকে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। অডিওতে শোনা যায়, আল-মালিকি সতর্ক করে বলেন, মোকতাদা আল-সদর এবং তাঁর কুর্দিস ও সুন্নি জোট পরাজিত না হলে ইরাক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে পতিত হবে। বিভিন্ন মিলিশিয়া বা সশস্ত্র বাহিনী আল-মালিকিকে সমর্থন করছে, যে মিলিশিয়ারা সহিংসতা ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যায় জড়িত।

ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী হাশদ আল-শাবি নামে পরিচিত। সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ইরাক ও ইরানে 'যুদ্ধ' করার জন্য অর্থায়ন করছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস। আইএস তিন বছর যুদ্ধের পর ধ্বংস হয়ে গেলেও ইরাকে তার খারাপ প্রভাব রেখে গেছে। তাদের কারণে ইরাকের সমাজ যে ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠতে যাচ্ছিল, সেই পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। বস্তুত আইএসের জন্ম হয় ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলা ও আগ্রাসনের পর দশকব্যাপী যুদ্ধের ফল হিসেবে। আমেরিকার ব্যর্থতায় সেখানে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এক দশকেরও অধিক সময়ের বিভ্রমের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক ত্যাগ করে, তখন ইরান সেখানে তার শক্তি বৃদ্ধি করে। ইরাকের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান প্রভাবক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

গত দুই দশকের সাম্রাজ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক ও বেসামরিক যুদ্ধের আগের দুই দশকের ইরাক ছিল আঞ্চলিক যুদ্ধ ও সহিংসতাপূর্ণ। আশির দশকের ইরাক-ইরান যুদ্ধের মাধ্যমে এর সূচনা। কুয়েতে ইরাকি হামলা এবং তৎপরবর্তী নব্বইয়ের দশকজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি পঙ্গু হয়ে যায়। পরিকল্পিতভাবে ইরাকের মানবসম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ পাচার করে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়। দেশটির সামাজিক সংহতি ও সেখানকার মানুষের 'স্পিরিট' নষ্ট করা হয়।

এটি ইরাকের দীর্ঘ যুদ্ধ ও সহিংসতার ফিরিস্তি। ফলে কয়েক প্রজন্ম ধরে ইরাকিরা কতটা হতাশাজনক ও অসহায়ত্বের মধ্যে বড় হচ্ছে, তা বলা বাহুল্য। এক শতাব্দীর পশ্চিমা উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ ও পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধের পুতুল হওয়ার জন্যই যেন ইরাক এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মানুষ বেঁচে আছে। এ অঞ্চলের কোনো বছর কিংবা কোনো দিন এমন যায়নি, যেদিন তারা দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখেনি।


ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্য ট্র্যাজেডির মূলে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিমের সাধারণ কিন্তু একই ধরনের ভয়ানক ভুল ধারণা। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে শুরু করা সহজ। বস্তুত, যুদ্ধ শেষ হলেও সংঘাত আসলে শেষ হয় না। যুদ্ধের ট্রমা মানুষের মধ্যে থেকে যায়। ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিশেষত তরুণরা তাদের বংশ, গোষ্ঠী, জাতি কিংবা নিজ ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে আশ্রয় খোঁজে। তারা স্থানীয় সশস্ত্র গ্রুপ কিংবা গ্যাং কিংবা অপরাধ চক্রে যোগ দেয়। কারণ তারা ভীতি ও নিরাপত্তহীনতার মধ্যে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতাটা এমনই। ২০০৬ সালে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডলিৎসা রাইস মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। বাস্তবে সেটাই আমরা দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, ইরাকে বিনিয়োগ বৃথা যাবে না। তাঁর ভাষায়, ইরাক যুদ্ধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং যত মানুষের জীবন দিতে হয়েছে; তার সাফল্য পাওয়া গেলে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেবে। সে সময় রাইস বলেছিলেন, ইরাকে শিগগিরই সহিংসতার অবসান ঘটবে- সেই সম্ভাবনা দেখেন না তিনি। বস্তুত সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর যুদ্ধ, আফগানিস্তান ও ইরাকে তাদের আক্রমণ এবং দখলের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই কার্যত জিম্মি হয়ে পড়ে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন প্রথম শুরু করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আক্রমণ ও দখলের পর আমরা দেখেছি, লেবাননের অবস্থাও একই রকম হয়। সেই ধারা এখনও অব্যাহত।

ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরান, সুদানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রত্যক্ষ করে আসছে। এসব সহিংসতা মূলত পশ্চিমের তৈরি। যদিও এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের দায়ও কম নয়।

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, এখন আবার ইরাকিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। রাজনীতি যেন আরেক যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতি হয়তো তেমন নয়। তবে রাজনীতি যদি যুদ্ধ ও সহিংসতা বন্ধের ওষুধ হয়; তবে সেটা অন্তত এ অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য নয়।

মারওয়ান বিশারা: আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্নেষক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক