
বৈচিত্র্যময় সমাজ। সমাজে দেখা যায় কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষের জীবনচিত্র। যাঁরা নিয়মিত ও পালাক্রমে ঘুরে ঘুরে চাঁদা আদায় করেন। প্রায়ই দেখা যায়, দলবদ্ধভাবে কোনো পথচারী বা খুদে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের দৃশ্য। এ ছাড়া যে কোনো আবাসিক ভবনে আকস্মিক প্রবেশক্রমে চাঁদা আদায়ের সংবাদ শোনা যায়। এ নিয়ে বিব্রত সাধারণ মানুষ। এসব বিক্ষিপ্ত আচরণের জন্য তাঁদের প্রতি সর্বসাধারণের ঘৃণা ও অবজ্ঞার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। তাঁরা কেন উপার্জনের অবৈধ মাধ্যম অবলম্বন করছেন? সামাজিকভাবে কি তাঁদের উপার্জনের কোনো বৈধ ক্ষেত্র নেই? এ শ্রেণির মানুষ কারা! তাঁরা হলেন 'হিজড়া' জনগোষ্ঠীর। তাঁরা যৌন প্রতিবন্ধিতার শিকার এবং মানবসত্তা হিসেবে আত্মপরিচয় সংকটে ভোগেন।
পরিবার তাঁকে মেনে নিতে চায় না। পারিবারিক বলয়ে শুরু হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও বৈষম্য। তাঁরা জীবনব্যাপী বৈষম্যের শিকার। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা 'হিজড়া' ব্যক্তিদের 'তৃতীয় লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র অত্যন্ত কঠিন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয় কর্তৃক 'হিজড়া ব্যক্তিদের মনো-সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মমুখী রিফ্রেশার্স' প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে একটি সেশন পরিচালনা করি। প্রশিক্ষণে তৃতীয় লিঙ্গের ৩০ ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মুখে জীবন চলার ক্ষেত্রে বিপত্তির কথা শুনে ব্যথিত হই ভীষণভাবে। কর্মক্ষেত্রের অভাব, উপার্জনের সুযোগ নেই, আবাসন সংকট, বেশি দামে ঘর ভাড়া দাবি, তীব্র পানির সংকট, সব জায়গায় গোসল বা শোচনকাজে বাধা, চিকিৎসা সংকটসহ নানা দুর্গতি। সভ্যতার উৎকর্ষের যুগেও নিরপরাধ তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে ঘৃণার পাত্র। সমাজের সব জায়গায় তাঁদের অংশগ্রহণ অতি সীমিত। তাঁদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক এবং মানব-মর্যাদা নিয়ে তাঁদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকেন। কর্মের মাধ্যমে তাঁরাও উপার্জন করতে চান। কিন্তু তাঁদের কর্মক্ষেত্র উন্মুক্ত নয়। স্বাভাবিক ও উপযোগী কর্মক্ষেত্র থেকে তাঁরা বিতাড়িত। তাঁদের আর উপায় কী! উপার্জনহীন ও অভুক্ত মানুষ কি বাঁচতে পারে? তাই সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শুধু বাঁচার তাগিদে রোজগারের মাধ্যম হিসেবে দলবদ্ধ হয়ে চাঁদা আদায়ের পন্থা অবলম্বন করেন।
একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা আমাদের স্বাধীনতার মহান অঙ্গীকার। সমাজের অসহায়, বঞ্চিত ও নিগৃহীত মানুষের কল্যাণে কাজ করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সরকারি এ দপ্তরের অন্যতম লক্ষ্য- সুবিধাবঞ্চিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা জোরদারকরণ। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এ অধিদপ্তর সারাদেশে বিশেষ ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এ দপ্তর। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের মধ্যে বিতরণ করা হয় মূলধন তহবিল, যাতে তাঁরা উপযোগী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় সরকার তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির কর্মসংস্থান, জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আত্তীকরণের লক্ষ্যে বিশেষ কর প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ২৫ জনের বেশি প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি নিয়োগ দেয়, তবে পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা করের ৫ শতাংশ রেয়াত হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান প্রতিষ্ঠায় সরকারের এক অনন্য উদ্যোগ।
আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার- সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার ভোগ করবে (সংবিধান, অনু-২৭)। তাঁদের সুরক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সব জায়গায় সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি অবজ্ঞা কিংবা বৈষম্য নয়; অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত সব মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ :সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম
newaz.usso@gmail.com
মন্তব্য করুন