তখন পশ্চিম বার্লিন। এসেছি তিন মাসের বেশি। শহর ঘুরছি। হেঁটে। বাসে। পাতাল রেলে। দ্রুতগামী ট্রেনে (স্নেলবান নামে পরিচিত। শহরের মধ্যেই চলাচল)। রাস্তাঘাট চিনছি। সাহিত্য-সংস্কৃতির আখড়ায় ঢুঁ মারছি। বইয়ের দোকানে। সিনেমা, থিয়েটার, আর্ট গ্যালারি, মিউজিক হলগুলোও চিনছি।
মোটা অঙ্কের স্কলারশিপ পাচ্ছি (ডয়েচ মার্ক)। দিচ্ছে একাডেমি ড্যের কুনস্টে (শিল্পকলা একাডেমি)। থাকছি গু্যয়েন্টার গ্রাসের ভিলা বাড়িতে। ভাড়া ছাড়া। খাওয়া-দাওয়াও ফ্রি। কিন্তু বিয়ার, ওয়াইন, সিগ্রেট নিজের গাঁট থেকে। এক প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস দুই ডয়েচ মার্ক। গু্যয়েন্টার গ্রাসের বড় ছেলে রাউল বুদ্ধি দিলে, জ্যুলোগিশার গার্টেন থেকে এসবানে (স্নেলবান; দ্রুতগামী ট্রেন) ফ্রিডরিসস্টাসের স্টেশনে (তৎকালীন পূর্ব বার্লিনে প্রবেশের পাঁচটির মধ্যে একটি) চলে যাও। সস্তায় সিগ্রেট পাবে।
গেলুম। দশ প্যাকেট সিগ্রেটের দাম পাঁচ ডয়েচ মার্ক (পশ্চিম জার্মানির। পূর্ব জার্মানির মুদ্রার নাম ডয়েচ মার্ক। পশ্চিম জার্মানির এক ডয়েচ মার্ক পূর্বে দশ ডয়েচ মার্ক)। দশটির এক কার্টনে কোথাও লেখা নেই মেড ইন দেশের নাম। সিগ্রেট বিক্রেতা সব ভিয়েতনামি। চোরাই বিক্রি। রাউল জানাল, পোল্যান্ডে তৈরি।
হোক। সস্তায় সিগ্রেট দরকার। স্বাদে অবশ্য হেরফের। পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন (পশ্চিম জার্মানির বন)। পূর্ব বার্লিনের আকর্ষণ ভয়ংকর। বিশেষত আলেক্সজান্ডারপ্লাৎস। ঢাকার রমনার পার্কের চেয়েও বড়। আশপাশে আরও দ্রষ্টব্য। বইয়ের দোকান, রেকর্ডের দোকান বিস্তর (ক্ল্যাসিকাল সুলভ। একটি বিশাল বইয়ের দোকানে নানা দেশের বই। নানা ভাষার। রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জসীম উদ্‌দীনের বাংলা বই।)
বই পড়ার বদভ্যাস নেই, লাইব্রেরিতে ঢোকার উদ্দেশ্য, নিশ্চয় কবুল করা পরহেজগারের দায়, বই নাড়াচাড়া, আঁতেলের পাকামো। মূল উদ্দেশ্য সুন্দরী (তরুণী/যুবতী) দেখা। আলাপও হয়।
আলেক্সজান্ডারপ্লাৎসে একিট বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর। নিচে মাছ বিক্রয়। পশ্চিম বার্লিন থেকে কয়েকজন বাঙালির নিয়মিত যাওয়া। শুক্র, শনিবারে।
আমাদের দেশীয় মাছ কাতলের মতো কার্পেন। পশ্চিম বার্লিনে এক কিলোর দাম চার ডয়েচ মার্ক (পশ্চিম জার্মানির)। পূর্ব বার্লিনে তিন মার্ক। (পশ্চিমের মুদ্রার বিনিময়ে ৩০ ফেনিংস) তিন/চার কিলো কিনতুম। আহা! সেই দিনগুলো!
-১৯৮৭ সালের জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরের কথা বলছি।
আলেক্সজান্ডারপ্লাৎস ঐতিহাসিক। ১৭৫১ থেকে এই চত্বর (প্লাৎস অর্থ চত্বর) রমরমা। বহুমান্য ঔপন্যাসিক আলফ্রেড ড্যয়েবলিনের বহুল পঠিত উপন্যাস 'আলেক্সজান্ডারপ্লাৎস।' বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফাসবিন্ডার আট ঘণ্টার ছবি করেছেন।
প্রসঙ্গত এও উল্লেখ্য, গু্যয়েন্টার গ্রাসের ঔপন্যাসিক গুরু আলফ্রেড ড্যয়েবলিন। গ্রাসের নিজের কথা :'ওঁর লেখার স্টাইল, লেখার বুনট, স্যাটায়ার ধারণ করেছি।'
গ্রাস বললেন, '৭ অক্টোবর (অক্টোবর বিপ্লব উপলক্ষে) মিখায়েল গর্বাচভ আসবেন, বক্তৃতা দেবেন (১৯৮৭)। আলেক্সজান্ডারপ্লাৎসে। বিকেল তিনটেয় গেলুম। লোকে লোকারণ্য। এলেন পাঁচটার আগে। তার আগে গান-বাজনা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে তিন/চারজন কথামালায় প্রগ্‌লভ। হয়তো পলিটব্যুরোর। নাম অজানা। অতঃপর পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রকর্তা এরিন হোনেকার। তাঁর বক্তৃতা শেষে মিখায়েল গর্বাচভ। রুশ ভাষায় কী বললেন, বিন্দুবিসর্গ বুঝিনি। বহু নর-নারী হাততালির সঙ্গে 'গোর্বি, গোর্বি' চিৎকার। বুঝলুম, তাঁরা রুশ ভাষা জানেন।
- হ্যাঁ, দুই জার্মানির পুনর্মিলনের আগে স্কুলে রুশ ভাষা ছিল দ্বিতীয়।
প্রথম দেখলুম গর্বাচভকে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে।
'এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো, আবার হবে তো দেখা।' মান্নাদের গানের কলি স্মরণ করছি।
ডয়চে ভেলের বার্লিনের বিশেষ সংবাদদাতার রিপোর্টার, নানা রাজনৈতিক রিপোর্ট।
বার্লিন দেওয়াল পতন। দুই জার্মানির একত্রীকরণ। কম্যুনিজমের ধস। গর্বাচভ হিরো।
দুই জার্মানির পুনর্মিলনের অনুষ্ঠানে হাজির। হঠাৎ চিৎকার (কয়েকজন)- 'বিশ্বাসঘাতক'।
গর্বাচভের চারটি প্রেস কনফারেন্সে হাজির ছিলুম। সাংবাদিকদের বহু প্রশ্ন এড়িয়ে যান। নিজেকে হিরো করার বয়ান (বলেন রুশ ভাষায়, সঙ্গে সঙ্গে জার্মান অনুবাদ দোভাষীর) কথায় গর্ব। এক পত্রিকার ভাষ্য, 'খলনায়কের বাচালতা'।
একটি সংবাদ সম্মেলনে যে প্রশ্ন করতে চাইছিলুম, করার আগে অন্য এক সাংবাদিক জানতে চান : 'জানেন, জর্জ বুশ (সিনিয়র) চীনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সিআইএর কর্তা। অতঃপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর সঙ্গে কেন দহরমমহরম?
ঘন ঘন মিটিং? কমিউনিজম, সোভিয়েত ইউনিয়নের ধসে?
প্রশ্নে কী কাণ্ড!
গর্বাচভকে এর আগে (কোনো প্রেস কনফারেন্সে) এমন মূর্তি দেখিনি। টেবিল চাপড়ে, লাফ দিয়ে উঠে প্রস্থান।
ঘটনার পরম্পরায় মনে হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পাঁয়তারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই। শুরু করেন পেরেস্ত্রকায় (অর্থনৈতিক সংশোধন) এবং গ্লাসনস্তে (মানবাধিকার)।
লক্ষণীয়, গ্লাসনস্তের প্রশ্নে সাংবাদিকের প্রশ্নে ক্ষিপ্ত।
জার্মানিতে (ইউরোপেও) গর্বাচভকে এক দল বলেন, 'দ্বিচারিতার প্রতিভূ। ভণ্ড। চরিত্রে ভণ্ডামি।'
এই অপবাদ কমিউনিজমে বিশ্বাসীদের। তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট ভাবতেন না; সংস্কারবাদী বলতেন।
সংস্কারে বিশ্ব খণ্ডিত, এই প্রশ্নে :'আমি সময়কালের।'
-হ্যাঁ, একনায়কও বলতেন একটু ঘুরিয়ে, 'বিশ্ব-সমাজ-দেশ-ঘটনা পরিবর্তনশীল। আমার আমিত্বে ছায়ামাত্র।'
সব খলনায়ক যা বলেন, গর্বাচভ একা নন। ইতিহাসে খল, প্রথম ও শেষ দেখায় (২০১৬) মনে হয়েছে।
দাউদ হায়দার :কবি