আজ ৯০ বছর বয়সে এসে ভেবে দুঃখ পাই- দেশের রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই; ছিনতাই হয়ে গেছে। আমাদের আগত-অনাগত প্রজন্ম এই রাজনীতির প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করবে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। অতীতের যে উদার এবং জনবান্ধব, দরিদ্রবান্ধব শোষিতবান্ধব ও নারীবান্ধব রাজনীতি সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অসংখ্য বিজয় ও গৌরব বয়ে এনেছিল; তা ছিল নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিকদের নেতৃত্বাধীন। 
ভাষা আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন এবং তা যে তরুণ সমাজ সংগঠিত করেছিল তার মধ্যে ছিলেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন কৃষক এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তান। গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্সহীন ছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই। কিন্তু উদারতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, প্রত্যয়ে তাঁরা ছিলেন আদর্শস্থানীয়। নতুন নতুন মানুষ তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানবদরদে উদ্বুদ্ধ এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদেরকে গৌরবান্বিত মনে করতেন। তাঁদের দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। আর আজ? ত্যাগ বলতে গেলে কিছুই নেই। বেশিরভাগই রাজনীতিতে এসেছেন প্রাপ্তির আশায়; দেওয়ার লক্ষ্যে নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিট, ঠিকাদারি প্রভৃতি পাওয়ার টার্গেট নিয়ে। টার্গেট ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পর নানা পথে বিদেশে পাচার করা। বিদেশের মাটিতে বাড়িঘর নির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্মীয়স্বজনের বিশ্বস্ত অংশকে এ কাজে নিয়োগ
দেওয়া ইত্যাদি। 
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক সম্মানবোধও রাজনৈতিক জগৎ থেকে আজ উধাও। পারস্পরিক দোষারোপের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা দেশে গণতন্ত্র সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে দূরে, বহু দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মও মুরুব্বিদের ওই দোষারোপের রাজনীতিকে পরিস্থিতির কারণে আঁকড়ে ধরছে। ফলে হানাহানি, কলহ, মারামারি, আঘাত, প্রত্যাঘাত হয়ে পছে নিত্যদিনের ঘটনা। মানুষ হতবিহ্বল, বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই সুযোগে কালো টাকার মালিক, সন্ত্রাসীরা রাজনীতির অঙ্গন দখলে নিয়েছে। পরিণতিতে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা হয়ে পড়ছে নিস্তেজ। নির্বাচনেও ভোটারদের সাড়া নেই। প্রায় বিনা ভোটেই নেতারা জিতছেন। কিন্তু জানানো হচ্ছে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তির কথা। আগের রাতেই ব্যালট বাক্স বোঝাই করার অবিশ্বাস্য নজিরও আমরা দেখলাম এই বাংলাদেশে।
দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশটা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব মহলেই মতৈক্য ভাসা ভাসাভাবে বিদ্যমান। একটি দুর্নীতি দমন কমিশনও আছে; কিন্তু তা যেন নখদন্তহীন; রাঘববোয়ালদের গায়ে হাত দিতে পারে না। ব্যাংক লুটপাটকারী ও তাদের সাহায্যকারীদের ধরার লক্ষণটুকুও দেখছি না। কারণ তারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট? দুদকের চোটপাট শুধু অসহায় শিক্ষকদের সঙ্গে। শিক্ষকদের মধ্যে যে দুর্নীতিবাজ নেই, তা নয়। তবে দুর্নীতিবাজদের তালিকা তৈরি করলে তাঁদের স্থান হবে সর্বনিল্ফেম্ন। অথচ সংবাদপত্রে দেখি, এমনকি কালেক্টরেটের পিয়নও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে; বাড়ি-গাড়ি হয়েছে, যা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তাদের ওই উপার্জন কাদের কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, তা গোপনই থেকে যাচ্ছে। 
দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরসহ সব জলাশয় ভরাট হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়, মৎস্য উৎপাদন হ্রাস, কৃষিতে সেচ বন্ধসহ নানা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে সব জেলা-উপজেলায়। নদী দখলকে বেআইনি ঘোষণা করে কয়েক বছর আগে হাইকোর্ট অবিলম্বে তা ইংরেজ আমলে রচিত সিএস খতিয়ান অনুযায়ী নদীর প্রশস্ত ও দৈর্ঘ্য নিশ্চিত করে খনন; উপযুক্ত গভীরতা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত জেলাগুলোয় একটি করে নদীও খনন করা হয়নি। বোঝাই যায়, তথাকথিত প্রভাবশালীরা বাদ সাধছেন। এ কারণেই উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে এমন অনীহা। বর্তমান রাজনীতিতে যদি অতীতের মতো দেশপ্রেম কাজ করত তবে এ জাতীয় বিষয় নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন একক বা যৌথভাবে উপরোক্ত সমস্যা সমাধানের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তুলত।
বর্তমানে বিরোধী দলের আন্দোলনও শুধু সরকার পতনের আন্দোলন। রাজনীতির এই করুণ হাল দেশকে গ্রাস করেছে। জনজীবনের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে যদি বিরোধী দলগুলো পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলত এবং তাতে অতীতের মতো গণসম্পৃক্তি ঘটাতে পারত তাহলে সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হতো এবং ঠিকই সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকারের পরিবর্তন ঘটাত। 
বিদেশে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য প্রভৃতি অপকর্মে সরকারদলীয় লোকরা জড়িত। তবু বিরোধী দল এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলে না বা গণআন্দোলন গড়ে তোলে না কেন? কারণ হয়তো এই; তলে তলে প্রধান বিরোধী দলের লোকেরাও অনুরূপ কাজে লিপ্ত কিংবা ক্ষমতায় গেলে তারাও এমন কাজে যুক্ত হবে। 
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখব, নির্বাচনপূর্ববর্তী কয়েকটি বছর, যেমন ১৯৪৮, '৫২, '৫৩ সালজুড়ে ছাত্র-যুবসমাজ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি দল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, রাজবন্দিদের মুক্তি, পাট ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, জননিরাপত্তা আইন, সংবাদপত্রের কণ্ঠ নিরোধক আইনসহ কতিপয় গণবিরোধী আইন বাতিলের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন ও সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার গঠনের দাবিতে আন্দোলন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে ছাত্র-যুবসমাজ ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করলে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ছাত্র-যুবসমাজ প্রণীত ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনী অভিযান পরিচালনা করায় নির্বাচন শুধু প্রশ্নাতীতভাবে সুষ্ঠুই হলো না; প্রায় সব আসনে (সারা প্রদেশে মাত্র ৯টি আসন ব্যতিরেকে) ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়নি। বস্তুত, জনমত প্রবল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু দেশে জনবান্ধব রাজনীতির নিদারুণ অভাব ঘটায় এবং শুধুই সরকার পতন ও গদি দখল মুখ্য বিষয়ে পরিণত হওয়ায় জনগণ রাজনীতি থেকে নীরবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রকৃত রাজনীতিকদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে কালো টাকার মালিকরা জেঁকে বসেছে।  
রণেশ মৈত্র :সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
raneshmaitra@gmail.com