
দৃশ্যত কয়েক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করে বেপরোয়া ও আগ্রাসী আচরণ করছে। চতুর্থবারের মতো মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জবাবদিহির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডেকে পাঠিয়েছে। এর মাঝে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গত সোমবার ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর (আসিয়ান) মিশনপ্রধানদের ব্রিফ করেন এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তবে ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের কোনো কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন না।
ওদিকে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে সীমান্তে গোলাবর্ষণের সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন গ্রুপকে (আরসা) দায়ী করেছে মিয়ানমার। তবে ভুলে গেলে চলবে না- ওপাশ থেকে যারাই সীমান্ত লঙ্ঘন করুক, তা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদিও মিয়ানমার দাবি করছে- আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সরকারের লড়াইয়ের ফলে এই সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে; এটাকে বাংলাদেশের প্রতি উস্কানি হিসেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কীভাবে ও কতভাবে এই উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, তাও খতিয়ে দেখতে হবে এখনই।
প্রথমত, রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি করে মিয়ানমার জান্তা বহু বছর ধরেই বাংলাদেশকে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার ইতিহাস বেশ পুরোনো হলেও, ২০১৭ সালে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বিতাড়ন এক ভয়ংকর মাত্রার সৃষ্টি করে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার তাদের সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে নতুন করে চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ঘটনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিভিন্ন ক্যাম্পে মানবিক সংকটের মাঝে থাকলেও, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, পরিবেশসহ অন্যান্য বিষয়ে নানা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকার সম্ভবত আশা করেছিল, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সামরিক বা শক্তি প্রদর্শনমূলক আচরণ করবে। এমনকি ২০১৭-১৮ সালে তারা সীমান্ত লঙ্ঘনের মতো ঘটনার সঙ্গেও যুক্ত ছিল, যাতে রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। অং সান সু চির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে গঠিত হাইব্রিড সরকারের সময়েও একই ধরনের চেষ্টা চলেছে। এখনও জান্তা নেতারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে শক্তি প্রদর্শনপূর্বক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁরা সফল হতে পারেননি বাংলাদেশের সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত নীতির কারণে।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে যেসব দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা হয়েছিল; মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে সেগুলোর লঙ্ঘনও করেছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য স্বাক্ষরিত সমঝোতা দুটি উল্লেখযোগ্য। চীনকে সঙ্গে নিয়ে যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হয়েছিল, তারও কোনো ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করে এবং পরবর্তী সময়ে এই প্রত্যাবাসনের সমঝোতাগুলোকে অগ্রাহ্য করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
চতুর্থত, মিয়ানমারের যে নিন্দিত, বেপরোয়া ও উস্কানিমূলক আচরণ সীমান্তে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও জড়িত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর মিয়ানমার জান্তা দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ চাপে রয়েছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের তুমুল সংঘাত। সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জান্তা সরকার মাত্র ১৭ শতাংশ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনইউজি তথা মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশের আধিপত্য নিয়ে চলছে সংঘাত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ তারই অংশ। এসব যুদ্ধে জান্তা সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জের ধরে এক ধরনের নাজুক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার ভেতর দিয়ে মিয়ানমার জান্তা সরকার যাচ্ছে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই থাক; সীমান্ত লঙ্ঘন হওয়া অথবা সীমান্তের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর।
পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জান্তা সরকার বেশ চাপে রয়েছে। তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র আসিয়ানের ভেতরেও ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া তাদের চাপে রেখেছে। বেশ কয়েকটি আসিয়ানের বৈঠকে জান্তা সরকারকে আমন্ত্রণ করা হয়নি।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা চাপের মুখে থাকা মিয়ানমার তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে একটি সামরিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়ার উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অতীতেও এই ফাঁদে পা দেয়নি, এখনও দেবে না। পরিস্থিতিকে বরং কৌশলগতভাবে বিবেচনা করছে। কেননা, সামরিক সংঘাত আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও পররাষ্ট্রনীতির মূল চেতনার পরিপন্থি। যুদ্ধ ও সামরিক জবাব কখনোই আবেগের ওপর নির্ভর করে হয় না। এমনকি সংবাদমাধ্যমেও জবাব দেওয়াটা সমীচীন নয়। কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে- এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে প্রকৃত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা জরুরি।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মিয়ানমারের আগ্রাসনকে সামরিকভাবে মোকাবিলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট সক্ষম। কূটনৈতিক পর্যায়েও এই সক্ষমতার নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মিয়ানমার জান্তাও এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে সামরিক সক্ষমতা থাকলেই তা প্রয়োগ করার সুযোগ সবসময় থাকে না। সে ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে- আশঙ্কা থেকেই যায়, তখন আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকার অভ্যন্তরীণ কোন্দল এক পাশে রেখে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সম্মিলিত চেষ্টা চালাবে। তাই বাংলাদেশ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
এ ছাড়া মিজোরামের ভেতরে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ এবং বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করানোর পাঁয়তারাকেও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থাকার পরও মিজোরামের বিষয়টি এক নতুন ধরনের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সময় এসেছে মিয়ানমারকে নিয়ে নতুন করে ভাবার। বিশেষ করে দেশটির বেপরোয়া ও উস্কানিমূলক আচরণ সারা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এমনকি মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোরও উচিত জান্তা সরকারকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা। কেননা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ও আগ্রাসী সীমান্ত কার্যকলাপ এ অঞ্চলে এমন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে, তার জন্য মূল্য দিতে হবে সবাইকে।
এটা ঠিক, মিয়ানমারের এই আগ্রাসন কূটনৈতিকভাবে আরও বড় পরিসরে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। আঞ্চলিকভাবেও আমাদের তুলে ধরতে হবে- মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না করে বরং একের পর এক নতুন সংকট তৈরির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটি চালিয়ে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে ভারত ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকলেও, বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিষয়টি তাদের নজরে আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাকে আরও বেগবান করতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে মাথায় রেখে। এ ক্ষেত্রে আসিয়ান, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। মনে করিয়ে দিতে হবে, মিয়ানমারের এই উস্কানি ও আগ্রাসী মনোভাব শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। মিয়ানমার রাষ্ট্রযন্ত্র প্রকৃতিগতভাবেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘসহ অন্যান্য ফোরামেও সীমান্ত সংঘন ও রোহিঙ্গা সংকটের ইস্যুটি জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। সীমান্তে মিয়ানমারের আক্রমণাত্মক আচরণ ও উস্কানির বিষয়টি বিশদভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে অবজ্ঞা প্রকাশ করছে, সেটিও আলোচনা হওয়া উচিত।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন