প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক ভারত সফর থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে 'খালি হাতে ফেরত আসিনি' বলে দাবি করেছেন। তবুও বলতে হবে, এবারের সফর থেকে বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাপ্তি নেই। কিন্তু গত সপ্তাহে একটি দৈনিকে খবর বেরিয়েছে, আগামী জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নাকি ভারত আর 'বাগড়া' দেবে না। ওই খবরে যেহেতু দু'জন প্রতিমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে; এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। তার মানে, দীর্ঘ-অপেক্ষমাণ ইস্যুটির জট খুলতে যাচ্ছে, বলা যায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি তিস্তাপাড়ের জনগণের বড় অংশের মধ্যে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। কারণ এটি বাস্তবায়িত হলে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার জনসাধারণের অমানুষিক ভোগান্তির অবসান হবে। প্রসঙ্গত, প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের দাবিতে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু সভা, সেমিনার, মানববন্ধন ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল- প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রবল আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছিল না। প্রায় চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প প্রণয়নে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন; যাতে একদা 'চীনের দুঃখ' হিসেবে আখ্যায়িত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে 'চীনের আশীর্বাদ'-এ পরিণত করেছে, একই কায়দায় একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের জন্য প্রতি বছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা যায়। বিভিন্ন খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বাস্তবায়নের পর প্রকল্প প্রস্তাবটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সঙ্গে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশও ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দু'তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচ খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুস্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপরন্তু নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে।
বিভিন্ন মাধ্যমে এসব তথ্য জেনে আমার মনে হয়েছে, তিস্তা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই দারিদ্র্যপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সে জন্যই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটির অনুমোদন হয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রকল্প প্রস্তাবের কোনো নড়াচড়া না দেখে খবরা-খবর নিয়ে জানা গেল, এতে ভারতের আপত্তি রয়েছে।


ভারতের দাবি ছিল, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের 'চিকেন নেক'-এর এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েকশ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের উপস্থিতি মেনে নেওয়ার মতো নয়। বিষয়টি বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের একটা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানরা কেন ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে? ওরা কি তাহলে প্রকৌশলীর ছদ্মবেশে চীনা সৈন্য-সামন্ত-গোয়েন্দা? যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে 'চিকেন নেক' অনেক দূরে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রকল্প এলাকায় অবস্থানরত চীনা নাগরিকরা ভারতে কীভাবে গোয়েন্দা তৎপরতা চালাবে? তিস্তা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটিতে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে, ততই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। ভারত তাদের সংকীর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেই যে এ প্রকল্পে বাগড়া দিয়েছিল, তা স্পষ্ট। আমরা দেখছি, সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও ভারত ২০২০ ও '২১ সালে চীনের সঙ্গে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারবে না?
তিস্তা ঐতিহাসিকভাবেই খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। আবার শুস্ক মৌসুমে তুলনামূলক খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতা হেতু সেচ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। তাই বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন-জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক তিস্তা নদীর বর্তমান পরিস্থিতি। নদীটির উজানে সিকিম বেশ কিছু ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে একতরফা পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর পর পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুস্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশিরভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে এহেন একতরফা বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দু'দেশ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্ক একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কাছে জিম্মি হতে পারে না। অথচ ভারত এ অজুহাতেই ১১ বছর ধরে এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও যৌথ ঘোষণায় তিস্তা চুক্তির কোনো আশ্বাস পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারে মুখ্যমন্ত্রী পদে যতদিন মমতা ব্যানার্জি এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রী পদে যতদিন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন থাকবেন, ততদিন তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সম্ভাবনা থাকবে কিনা, সন্দেহ।
এটাও মনে রাখা উচিত, ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি এবং প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক; প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন-জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুস্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে; তার কোনো সমাধান হবে না। প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহূত হলে এ সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে। এখন প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প থেকে ভারতের আপত্তি প্রত্যাহারের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন- প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনে আর বিলম্ব করবেন না।
ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়