কোনো জাতির তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করতে চাইলে প্রথমেই সে জাতির শিল্প-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয়। নানা অজুহাতে শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার অন্তরায় হিসেবে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করাতে হয়। সম্প্রতি নাট্যকর্মীদের একটি দাবির বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা দেখে এ কথাই মনে এলো।

নাট্যকর্মীরা রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর সেকশনে একটি 'আধুনিক নাট্যমঞ্চ' নির্মাণের দাবি করে আসছেন দুই দশক ধরে। যেখানে থাকবে নাটক, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, আবৃত্তিসহ শিল্পের সব শাখার আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ মঞ্চ, গ্যালারি ও পাঠাগার। ১৯৭৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মিরপুর-১০ নম্বরে একটি টাউন হল ছিল। তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে এবং মিরপুর উন্নয়ন কমিটির তত্ত্বাবধানে টাউন হলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই টাউন হলে মিরপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। ২০০৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে হলটি ভেঙে ফেলা হয়। এর পর সেখানে সিনেপ্লেক্স, নাট্যমঞ্চ এবং সংস্কৃতিচর্চার নানা সুযোগ-সুবিধাসহ একটি বহুতল টাউন হল নির্মাণের কথাও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি।

দুঃখের বিষয় হলো, পরে সিটি করপোরেশন একটি বেসরকারি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সেখানে 'মার্কেট' তৈরির পরিকল্পনা করে। অবশ্য এলাকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। সেই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, পথনাটক পরিষদসহ অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন। এর পর ২০১৩ সালে সংস্কৃতিকর্মীরা নিজ উদ্যোগে টাউন হলের শূন্যস্থানে একটি মুক্তমঞ্চ তৈরি করেন। কিন্তু বর্তমানে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি রাখায় সেটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশন তাদের ময়লার গাড়ি রেখে জায়গাটিকে 'ময়লার ডিপো' বানিয়ে ফেলেছে, যা খুবই দুঃখজনক। এই 'ময়লা সংস্কৃতি' আজ তরুণ প্রজন্মকে হতাশার জালে বন্দি করে ফেলছে।

ফলে চলতি বছরের আগস্ট মাসে স্থানীয় নাট্যদল 'অপেরা' টাউন হলের ফাঁকা জায়গায় নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করার দাবিতে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন শুরু করে। মিরপুরে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। অথচ ৬০ লাখ মানুষের বসবাসের এ এলাকায় কোনো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই। মঞ্চ না থাকার কারণে তাদের সেগুনবাগিচায় গিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান করতে হয়। নাটক মঞ্চায়ন করতে হলে সেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে শিল্পকলায় গিয়ে অনুষ্ঠান করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

তাই মিরপুরের সংস্কৃতিচর্চাকে আরও বেগবান করতে টাউন হল চালু করা অতি জরুরি। শিগগিরই নতুনভাবে টাউন হলের ফাঁকা জায়গায় আধুনিক নাট্যমঞ্চ করা এখন সময়ের দাবি। কেননা, মিরপুরের মতো জনবহুল স্থানে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা আছে। এর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করতে হবে স্থানীয় জনগণকেও। যৌক্তিক এই দাবির সপক্ষে এগিয়ে আসা উচিত স্থানীয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। এগিয়ে আসা উচিত সিটি করপোরেশনকেও। নাগরিকের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।

আমরা জানি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার জন্য সিটি করপোরেশনেরও উদ্যোগ থাকার কথা। ২০-২৫ বছর আগে যে জায়গাটিতে টাউন হল ছিল, সেটি নিয়ে কী পরিকল্পনা ছিল, তার আদ্যোপান্ত খুঁজে বের করা উচিত। এর জন্য সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ময়লা রাখার জন্য অন্যত্র স্থান নির্ধারণ করা উচিত। বিভিন্ন জায়গায় তাদের আঞ্চলিক অফিস আছে। সেসব অফিসের পাশের খালি জায়গায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি রাখা হয়। এখানে যদি তাদের অফিস থাকে, তাহলে তা সরিয়ে নেওয়া জরুরি।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী