
বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের জন্য বিপুলভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখা শিল্প, কৃষি, সেবাসহ পরিবহন খাত সম্পূূর্ণরূপে বিদেশ থেকে আমদানি করা এ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় জ্বালানি সরবরাহ যদি কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা জ্বালানি তেলের বাজার যদি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে তাহলে এর প্রভাব দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। এটাই স্বাভাবিক।
বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকলেও করোনার কারণে সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা) ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একই সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ দেশের জ্বালানি খাতে এক ধরনের সংকট তৈরি করেছে। এ থেকে উত্তরণের অন্যতম পন্থা হচ্ছে দেশে বেশি বেশি জ্বালানি মজুতাগার ও পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল পরিশোধনাগার স্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে কম মূল্যে তেল ক্রয় করে তা মজুত করা গেলে সংকটকালে বেশ ভালো ফল দেবে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা উচিত বলে আমি মনে করি এবং এখনই এর উৎকৃষ্ট সময়। সরকার যদি এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হয় তাহলে আমরা আরও উন্নতমানের জ্বালানি পাব এবং সংকটকালীন পরিস্থিতির উত্তরণেও এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দেশের জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এলে তা এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি করবে, যা ভোক্তা পর্যায়ে কিছুটা হলেও সুফল বয়ে আনবে।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও মূল্যস্টম্ফীতি দেখা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের মতো চূড়ান্ত আমদানিনির্ভর দেশগুলো। কারণ, এ দেশগুলোর জন্য জ্বালানির চাহিদা এবং খরচ সমন্বয় করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করে। তবে এর গুণগত মান এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। নিম্নমানের ডিজেল ব্যবহারের কারণে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমরা পরোক্ষভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদের গাড়ির যে স্পেয়ার পার্টস রয়েছে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ যন্ত্রাংশ আমদানি করার কারণে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বহির্বিশ্বে যেখানে ইউরো ৪ ও ইউরো ৫ ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে, সেখানে নিম্নমানের ডিজেল ব্যবহারের কারণে অত্যাধুনিক ইঞ্জিন ব্যবহার আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সময় এসেছে।
বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে সম্ভাবনাময় সব এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে দেশের উন্নয়নের গতি বাড়াতে সরকার ইকোনমিক জোন তৈরি করেছে। এ জোনগুলোতে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। এ মুহূর্তে দেশের জ্বালানি খাত নিয়ে কোনোরকম শঙ্কা দেখা দিলে তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। তবে দেশের জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, পণ্যের রপ্তানি বাড়বে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হতে পারব।
দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানি খাত টেকসই করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও এ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য জ্বালানি সাশ্রয়ী মূলধনি যন্ত্রপাতি বা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি সাশ্রয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড নীতিমালা হালনাগাদ করা। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করার জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। সবশেষে যেসব যানবাহন কালো ধোঁয়া নির্গমন করে পরিবেশ দূষণ করে, তাদের বেসরকারি সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সঠিকভাবে তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি যানবাহনকে বিকল্প পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করা। এ ক্ষেত্রে এলপিজি একটি বিকল্প হতে পারে।
বর্তমান সময়ের জ্বালানি সংকট নিরসনে এরই মধ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ (ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস, সরকারি-বেসরকারি অফিস কিংবা বাসায় এসি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে না রাখা, শপিংমলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনা প্রভৃতি) গ্রহণ করেছে তা বেশ আশাব্যঞ্জক। এ পরিস্থিতিতে জনগণেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের সবাইকে সরকারের গৃহীত এ পদক্ষেপ যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নিশ্চিত করতে হবে এবং সিস্টেম লস কমাতে হবে। সর্বোপরি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে শিগগিরই এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সামনের দিনগুলোতেও এ রকম সংকটকালীন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ টেকসই জ্বালানির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে।
হুমায়ুন রশিদ: সিআইপি, চেয়ারম্যান, এনার্জি পাওয়ার ও ইউটিলিটি কমিটি, এফবিসিসিআই
মন্তব্য করুন