রাষ্ট্র বা রিপাবলিকের ধারণা সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই রাজ্যে রাজ্যে যুদ্ধ, দূতিয়ালি, সন্ধি ইত্যাদি রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এসবের জন্য আবার ডিপ্লোম্যাসি তথা কূটনীতি সব সময়ই অপরিহার্য।

কূটনীতি, রাজনীতি বা কূটকৌশলের ক্ষেত্রে দুটি নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০-২৭৫ সময়ে প্রাচীন ভারতে মগধ রাজ্যের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, পণ্ডিত চাণক্য আর ১৫ শতকের ইতালির ফ্লোরেন্টাইন রিপাবলিকের রাজনৈতিক দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি। এ নাম দুটি বাংলা শব্দ 'ধুরন্ধর' বা ইংরেজি শব্দ 'অ্যাস্টিউট'-এর প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। এই অর্থে ম্যাকিয়াভেলির বিশেষণ ম্যাকিয়াভেলিয়ান আর চাণক্যের বিশেষণ চাণক্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রায় ১৮০০ বছরের ব্যবধানে লেখা হলেও চাণক্য তথা কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র' ও ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স'- দুটি গ্রন্থেই রাষ্ট্র, রাজনীতি, কূটনীতি, সরকার, আমলা, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে এবং বক্তব্যও মোটামুটি একই রকম। আরও বিস্ময়কর হলো, তাঁরা দু'জনেই শুধু লেখক বা পণ্ডিত নন; তাঁদের এ জ্ঞান অভিজ্ঞতালব্ধ। চাণক্যের সর্বাত্মক সাহায্যেই রাজা চন্দ্রগুপ্ত নন্দ বংশের অবসান ঘটিয়ে মৌর্য বংশের রাজত্ব কায়েম করেন এবং এর পর চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের পরামর্শক হিসেবে ও তাঁর উত্তরসূরি বিন্দুসারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্টাইন রিপাবলিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান হিসেবে রিপাবলিকের পক্ষে অন্য অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা এবং কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনে একবার লিডার তথা নেতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল অনেকটা এ রকম- নেতা হচ্ছেন সেই ব্যক্তি; মানুষ নিজের অজান্তেই যাঁর দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, যাঁর স্টাইল অনুকরণ করে, যাঁর উপমা অনুসরণ করে। যেমন ধরুন- নেহরু বা জিন্নাহ কোনোদিন তাঁদের টুপি কাউকে পরতে বলেননি। বঙ্গবন্ধু কাউকে তাঁর কোট পরতে বলেননি। অনুসারীরা নিজের অজান্তেই এটা করেছিলেন।

অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান গুণ। কারণ সব কাজ তাঁর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনিই যোগ্য নেতা, যিনি অসংখ্য নেতা তৈরি করার ক্ষমতা রাখেন। নেতা তৈরি করার উপায় কী? উপায় হলো অনুপ্রাণিত করা। আর একবার অনুপ্রাণিত হলে তিনি নেতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবেন। সব সমস্যায় যদি নেতাকেই এগিয়ে আসতে হয়; বুঝতে হবে, তিনি নেতা তৈরি করতে পারেননি। নিজের ও দলের আদর্শে কর্মীদের উজ্জীবিত করতে পারেননি।

কাউকে কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া বা ক্ষমতা প্রত্যর্পণের আদর্শ পদ্ধতিটা কী, দেখা যাক। হেনরি কিসিঞ্জারকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিক্সন ক্ষমতা গ্রহণের আগেই বেশ কয়েকবার বৈঠক করেন তাঁর সঙ্গে। কিসিঞ্জার আগে যাঁদের অধীনে কাজ করেছেন, তাঁদের কাছে তাঁর কর্মদক্ষতা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছেন। একবার নিক্সন কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, 'কূটনীতির লক্ষ্য কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?' তখনও কিসিঞ্জার ঘুণাক্ষরে টের পাননি কী উদ্দেশ্যে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে এতবার দেখা করছেন, আর কেনইবা এত প্রশ্ন করেছেন।

হেনরি কিসিঞ্জার জন এফ কেনেডির সময়েও হোয়াইট হাউসে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। নিক্সনের সঙ্গে কাজের কথা আগেই বলা হয়েছে। দুই প্রেসিডেন্টই নিরাপত্তা ও কূটনীতি বিষয়ে লেখা কিসিঞ্জারের বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কাজ করার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা কিছুদিন পরপর একাডেমিক স্কলারদের নিমন্ত্রণ করেন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য। একবার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নেলসন রকফেলার এমনি এক সমাবেশে স্কলারদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনাদের কাজ হলো, যেটা ঠিক সেটা বলা এবং আমাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া।' তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ারস'-এ কিসিঞ্জারের আরেকটা চমৎকার ঘটনার উল্লেখ আছে : কিসিঞ্জার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জনসনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ওভাল অফিসে গেলে তিনি বলেছিলেন, 'অধ্যাপক, আপনাকে একটি পরামর্শ দিয়ে যাই- পত্রিকার কলামগুলো নিয়মিত পড়তে ভুলবেন না।'

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক অর্থনীতির গুরু হ্যারল্ড লাস্কি তাঁর 'আ গ্রামার অব পলিটিক্স' বইয়ে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, সমষ্টি, ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, নেতা, কর্মী এবং এসব প্রপঞ্চের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রায় ২১০০ বছরের ব্যবধানে লেখা প্লেটোর 'রিপাবলিক'-এর সঙ্গে লাস্কির এ বইয়ের অদ্ভুত মিল। প্লেটো বলেছেন, 'সমাজের প্রতিটি অংশকেই বিকশিত হতে দিতে হবে এবং বিকাশটা হতে হবে স্বতন্ত্র। একের বিকাশ অন্যের বিকাশের বিনিময়ে নয়।' আর লাস্কি বলেছেন, 'প্রত্যেক ব্যক্তিই একটা আলাদা সত্তা, তাঁর নিজস্ব একটা জগৎ (স্পেস) দরকার এবং তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বেড়ে ওঠা দরকার।' রাষ্ট্র বা নেতার প্রতি জনগণ বা কর্মীর আনুগত্য বিষয়ে লাস্কি বারবার বলেছেন, 'এটা চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়। এটা ব্যক্তির ভেতর থেকে আসতে হবে। সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড অথবা নেতার প্রতিদিনের জীবনাচরণ দেখে ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেয় সে অনুগত থাকবে কি থাকবে না।' বাংলাদেশের যে কোনো নেতার জন্য এই কথাটার গুরুত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও বড়।

রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা হ্যারল্ড লাস্কির 'আ গ্রামার অব পলিটিক্স' বাংলায় অনুবাদ করে ছোট, মাঝারি, বড় সব নেতার জন্য পড়ানোর ব্যবস্থা করুন এবং নিজেরাও বারবার পড়ুন আর বলুন-

'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।'
তা যদি করতে পারেন, দেশে পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

ড. এন এন তরুণ: রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail.com