দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, তাকে উদ্বেগজনক বললে ভুল হবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪৩৭ জন, যে সংখ্যাটা আগের দিন ছিল ৪৩১। বিষয়টা উদ্বেগজনক হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১২ হাজার ৮৭৫ জন। তাঁদের মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৬৯৪ জন। বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, কমপক্ষে আরও এক মাস এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থাকবে।

সম্ভবত ডেঙ্গু চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির কারণে এবং মানুষের মধ্যে সময়মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ার কারণে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু গতবারের চেয়ে একটু কম দেখা গেলেও একেবারে কম নয়। গত বছর প্রাণঘাতী এ রোগে মারা গিয়েছিলেন ১০৫ জন। এবার বুধবার চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণকারী দুইজনসহ এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৮ জন। এদিকে এডিস মশাবাহিত এ রোগ এক সময় শুধু ঢাকা বা বড় শহরকেন্দ্রিক থাকলেও এখন তা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন নতুন আক্রান্তের মধ্যে ৩০৬ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; বাকি ১৩১ জন ভর্তি আছেন ঢাকার বাইরের চিকিৎসা কেন্দ্রে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে ঢাকা মহানগরে মারা গেছেন ২১ জন, কক্সবাজারে ১৮, চট্টগ্রামে ৫ ও বরিশালে ৪ জন। অর্থাৎ, ডেঙ্গু সচেনতনতা শুধু ঢাকাবাসীর মধ্যে থাকলেই চলবে না; সারাদেশেই তা গড়ে তুলতে হবে। ডেঙ্গু জীবাণুবাহী মানুষের চলাচল যেহেতু এক জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয় এবং এডিস মশাও যেহেতু নগর-মহানগরে সীমাবদ্ধ নয়, তাই ব্যাপক জনসচেতনতার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা সারাবছর থাকলেও সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবরকে এ রোগের মৌসুম ধরা হয়। তা ছাড়া অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বরের পর এর প্রাদুর্ভাব কমে যেতে দেখা গেলেও, আগেই বলা হয়েছে, এবার অক্টোবরকেও বিপজ্জনক ধরা হচ্ছে। এর কারণ হলো, এ বছর বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে; আগের মাসগুলোতে তেমনটা দেখা যায়নি। এ ধরনের বৃষ্টিতে বেশি সময় ধরে স্বচ্ছ পানি জমে থাকার পরিবেশ তৈরি হয়, যে ধরনের পানি এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়ক বলে বিশেষজ্ঞদের কল্যাণে আমরা সবাই জানি। কিন্তু দুঃখজনক হলো, গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ডেঙ্গুবিরোধী যত তৎপরতা দেখা গেছে, এ বছর তেমনটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে নগরবাসীকে ডেঙ্গুর বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার একটা প্রয়াস তাদের দিক থেকে দেখা গেছে, এটা ঠিক। তবে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে পাড়া-মহল্লায় ধারাবাহিক অভিযান চালানোর বিষয়টি একটু কম গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর এ আপাত উদাসীনতার একটা কারণ হতে পারে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু বিশেষ করে রাজধানীতে যেভাবে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবার পরিস্থিতি এখনও সে রূপ ধারণ করেনি।

২০০০ সালে দেশে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার পর ওই বছরই সর্বোচ্চ ১২০ জন ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন। রোগীর সংখ্যাও ছিল ইতিহাসে সর্বোচ্চ- এক লাখেরও বেশি। মূলত ওই বছর ডেঙ্গুসংক্রান্ত চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল বলে প্রমাণিত হয়। তখন সরকারসহ বিভিন্ন মহলের যথেষ্ট উদ্যোগের কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পরবর্তী বছরগুলোতে ভয়াবহ রূপ নিতে পারেনি।

তাই বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম- এ চেতনার আলোকে জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে আমরা মনে করি। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে এ জন্য তৎপর হতে হবে। তবে এসব উদ্যোগের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।