জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। বাবার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই তিনি সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন এবং উপযুক্ত কর্মসূচি নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারোর একটি কথা স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, একটা ভালো সমাজ হলো তা, যেখানে নেতৃত্বের মধ্যে জনগণের জন্য 'শ্রদ্ধা' ও 'ভাবনা' কাজ করে।
আমি জানি, শেখ হাসিনার কৌশল ও কর্মসূচি সম্পর্কে যে কোনো খণ্ডিত আলোচনা অবশ্যই দরিদ্র মানুষের জীবন পাল্টানোর কাজকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা পূর্ণরূপে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। তারপরও শেখ হাসিনা প্রমিথিউসের মতো অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষদের কাছে আলো পৌঁছে দিতে যেসব বৈপ্লবিক কার্যক্রম সম্পাদন করেছেন, সেগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান আমি তুলে ধরব।
শেখ হাসিনা প্রথম সরকার গঠন করেন ১৯৯৬ সালে। তখন একদিকে দেশে চলছিল বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং, আরেকদিকে দাতারা বিদ্যুৎ খাতে কোনো বিনিয়োগ না করার পণ করেছিল।
শেখ হাসিনা এ অবস্থায় এক সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করলেন, যা আগে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। এক মার্কিন কোম্পানিকে ৮১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাইসেন্স দিলেন যখন কোম্পানিটি বিশ্বের সবচেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে রাজি হলো। এর সঙ্গে মোট ৩১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটো বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র বসল। এভাবে তখন জাতীয় গ্রিডে ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন তিনি, যা মানুষকে অনেক স্বস্তি এনে দেয়। একই সময়ে তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেন। এমনকি তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করারও সুযোগ দেন। তখনই তিনি ২০২০ সাল নাগাদ সবার জন্য বিদ্যুতের ঘোষণা দেন; তৎকালীন বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি বিবেচনায় যা ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী এক ভাবনা।
ওই মেয়াদে মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙে শেখ হাসিনা আরেকটি যুগান্তকারী কাজ করেন। প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে তিনি তিনটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিকে এখানে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেন, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
সাত বছরের বিরতির পর শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হন। ততদিনে আগের সরকার দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতিকে আবারও অসহনীয় করে তোলে। তাই শেখ হাসিনা এ সেক্টরে আবারও কিছু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেন। প্রথমেই তিনি দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বার্থে প্রচলিত সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনেন। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য তৈরি করেন একটা জরুরি আইন। এ আইনের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর আয়োজন করেন। তেলের দাম খুব বেশি হলেও তিনি এখানে বিদ্যুৎ না থাকলে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে চরম কাফফারা দিতে হয়, তা বিবেচনায় নেন। একই সঙ্গে তিনি বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য সংশ্নিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিজের উৎস থেকে অর্থ বরাদ্দ দেন। ব্যাপকভাবে বিশেষ করে জাতীয় গ্রিডবহির্ভূত এলাকার জন্য সোলার হোম সিস্টেম তখনই চালু হয়।
প্রধানমন্ত্রী এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি সুলভ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনেও উদ্যোগী হন। পাবনার রূপপুরে সেই '৬০-এর দশকে একটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু তা কিছুদিন পরই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শেখ হাসনিা সেখানে ১২০০ করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে দুটো পারমাণবিক চুল্লি বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। রাশিয়ার অর্থায়নে ও কারিগরি সহযোগিতায় সেখানে ২০১৭ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হয়। আশা করা হচ্ছে, ২০২৩ সাল নাগাদ প্রথম কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
শেখ হাসিনার আরেকটি বিশেষ উদ্যোগ হলো বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে আঞ্চলিক সহযোগিতার অন্বেষণ। এর অংশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকেই ভারত থেকে বিদ্যুৎ পেতে শুরু করেছে। বর্তমানে গড়ে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এভাবে ভারত থেকে আসে। আশা করা হচ্ছে, এ বছরই ঝাড়খন্ডের আরেকটা প্রকল্প থেকে আরও বিদ্যুৎ আসবে। শেখ হাসিনা আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় ভুটান ও নেপাল থেকেও বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করছেন।
শেখ হাসিনার আরেকটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ হলো জনগণকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী করে তোলার চেষ্টা। এ পৃথিবীর টিকে থাকার স্বার্থে পশ্চিমারা ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবহারে এ আচরণগত পরিবর্তনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শুধু এ নিয়ে কথাই বলছেন না; বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাস্টেইনেবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ও বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার রিসার্চ কাউন্সিল (বিইপিআরসি) নামক দুটো প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেছেন।
শেখ হাসিনার এসব উদ্যোগের ফল হয়েছে দারুণ। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫০০০ মেগাওয়াটেরও বেশি; ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ পেত ৪৫ শতাংশ মানুষ; এখন তা পাচ্ছে দেশের সব লোক। মাথাপিছু আয়ও ২০০৯ সালের ৭০০ ডলার থেকে চার গুণ হয়ে ২৮০০ ডলার ছুঁয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ভুক্ত এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশগুলোর কাতারে নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছেন। একই সময়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনও হবে যথাক্রমে ৩০ হাজার মেগাওয়াট ও ৫০ হাজার মেগাওয়াট।
শেষ কথা। বর্তমানে দেশে যে জ্বালানি সংকট চলছে তার উৎস জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং উন্নত দেশগুলোর মধ্যকার যেখানে যতটুকু জ্বালানি আছে তা কিনে নেওয়ার প্রতিযোগিতা। এ সংকট অনেক দূরের দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। ২০০৯ সালের চেয়ে বর্তমানে আমরা তিন গুণ জ্বালানি উৎপাদন করি। এর পরও আমরা সংকটে আছি। 'জ্বালানির দায়িত্বশীল ব্যবহার'-এর মাধ্যমে আমরা এ সংকট একসঙ্গে মোকাবিলা করব; মিতব্যয়িতা ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা নিয়ে আমরা এক গর্বিত জাতি। এ সংকট অবশ্যই কেটে যাবে।
(ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তরিত)

ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম : প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা