- মতামত
- অকুতোভয় শেখ হাসিনা
অকুতোভয় শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ চার দশক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে; জেল-জুলুম ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জনগণের রায় নিয়ে চারবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের হাতে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন। ওই সময় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। '৮১-এর ১৭ মে নির্বাসন শেষে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। যেদিন প্রিয় নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না; ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। স্বৈর শাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা; অন্ধকারের অমানিশা দূরীকরণে আলোর পথযাত্রী।
'৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল তখন তিনি দলের হাল ধরেন। '৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে আমরা জীবনপণ চেষ্টা করে, সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে, আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করে, তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছিলাম দলের রক্তভেজা সংগ্রামী পতাকা। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর ও মহত্তর প্রয়োজনে তাঁর আগমন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ। নেতৃত্ব গ্রহণের পর তাঁকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন।
'৮১-তে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলন সংগঠিত করেন। সামরিক শাসকের নির্দেশে '৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকেসহ আমাদের শীর্ষ নেতাদের সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং বিনা কারণে একটানা ১৫ দিন আমাদের আটক রাখা হয়। '৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষায় বহু নেতাকর্মী প্রাণ বিসর্জন দেন। '৯০-এর ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। প্রবল গণরোষের ভয়ে সামরিক সরকার ওই দিনই তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর '৯১-এর ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ঘাতকের সর্বশেষ নিষ্ঠুর আঘাত এসেছিল ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে। সেদিন প্রিয় নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন দিতে হয়েছে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মীকে। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মোট ২১ বার হামলা হয়েছে। অকুতোভয় শেখ হাসিনার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মতোই অসীম সাহসী। চিত্ত তাঁর ভয়শূন্য!
তাঁর নেতৃত্বে একটানা বহু বছর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন একটি সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছিল) হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাছে থেকে তাঁকে দেখেছি। যখন তাঁর কাছে বসে কেবিনেট মিটিং বা সভা-সফর করেছি, তখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য ছিল; তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা-ই পালন করতেন। একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বিষয়ে আপস করতেন না এবং ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও মাথা নত করতেন না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জাতির পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সেই আদর্শ অর্জন করেছেন। তিনিও লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণে থাকেন অবিচল। '৮৬-তে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। '৯১-তেও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মাগুরার একটি উপনির্বাচনে বিএনপি যখন পরাজিত হতে চায়নি এবং জোর করে ভোট ডাকাতি করেছিল, তখন বাধ্য হয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে বিজয়ী হয়ে '৯৬-এ গণরায় নিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। '৯৬-তে 'ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স' বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত করেছেন। ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সেই বিচারের পথ বন্ধ করে দেন। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভূমিধস বিজয় অর্জনের পর ২০০৯-এ সরকার গঠন করে সেই বিচারের কাজ শেষ করে আদালতের রায়
বাস্তবায়নের পথ করে দেন। বাংলার মাটিতে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। যেখানে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিলেন; সেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মানুষকে কলঙ্কমুক্ত করে চলেছেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা অকুতোভয় চিত্তে দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নতির শিখরে। জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাই।
তোফায়েল আহমেদ :আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
tofailahmed69@gmail.com
মন্তব্য করুন