
পৃথিবীতে খুব অবাক হওয়ার মতো একটা ঘটনা এখন ঘটছে। মানুষ নিজের অজান্তেই তার সহস্র বছরের সাধনার ধন খোয়াতে বসেছে। মানুষ যে এর আগে তা হারায়নি, তা নয়। কিন্তু সেটা সে হারিয়েছে স্বেচ্ছায়। কিন্তু একটু একটু করে অর্জিত যে যোগ্যতা দিয়ে সে পৃথিবীতে তার প্রভুত্ব কায়েম করেছে; সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছে; তা যে এখন কোন রল্প্রব্দপথে কোথা দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে- টেরই পাচ্ছে না। তাকে নিয়ে রচিত কবিতার চরণ- 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান' যে এখন ক্রমে ফাঁপা বুলির মতো শোনাচ্ছে, তা সে বুঝেই উঠতে পারছে না।
মানুষ হিসেবে এখন যেসব মানসিক দক্ষতা নিয়ে গর্ব করি, তা আমরা মূলত ৭০ হাজার বছর আগে যখন প্রথম কগনিটিভ বিপ্লব শুরু হয় তখন থেকে অর্জন শুরু করি এবং ১০ হাজার বছর আগেই সে অর্জন প্রায় সম্পন্ন হয়ে যায়। সেই সময়েই আমরা আমাদের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কিল যেমন সহমর্মিতা, সহযোগিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, নৈতিকতা, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ইত্যাদি অর্জন করে ফেলেছিলাম। তার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আমাদের প্রখর ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও অখণ্ড মনঃসংযোগের ক্ষমতা। এর পর কৃষিসমাজে এসে এগুলোর কিছুটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে এগুলো কমতে শুরু করে এবং একবিংশ শতাব্দীতে সেগুলোর অস্তিত্ব হয় বিলীন, না-হয় হুমকির মুখে।
আমরা যে আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে কত শক্তিশালী করে তুলেছিলাম, সেটা একটু বলি। শিকারি সমাজের মানুষ শুধু ঘ্রাণ শুঁকে কোথায় কোন প্রাণী বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তা দূর থেকে না দেখেই বলে দিতে পারত। কে কী ভাবছে, সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারত। যেমন ভয় ও সাহসের জন্য যে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরিত হয়, তা তারা গন্ধ শুঁকে আলাদা করে চিনতে পারত। সে সময় একজন সেনাপতি গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন, তাঁর দলে ক'জন সৈন্যের সত্যিকারের সাহস আছে।
আমাদের মনঃসংযোগের ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। শ্বাপদসংকুুল অরণ্য আমাদের সদাসতর্ক করে রাখত। বাতাসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে বা মাটিতে পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে করে সেই দুর্গম অরণ্যে বিচরণ কোনোভাবেই রোমান্টিকদের অলস নিসর্গ ভ্রমণ ছিল না। খাদ্যদ্রব্যের বেলায়ও তা-ই। জোগাড় করা খাবার প্রাণসংহারী কিনা, তা পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে পরীক্ষা করেই মুখে দিতে হতো। কিন্তু এখন খাওয়ার সময় প্লেটে কী থাকে, তাই তো ঠিকমতো দেখি না। এমনকি মুখের ভেতর দেওয়ার পরও তার স্বাদটা মন দিয়ে চাখি না। কারণ আমাদের চোখ আর মন দুটোই তো তখন টিভি বা নেট দুনিয়ায় নিবদ্ধ।
হারিয়ে যাওয়া এই অসাধারণ ক্ষমতার কথা উঠলে প্রযুক্তিবাদীরা বলবেন, এ তো অবধারিত। যেহেতু প্রয়োজন নেই, ওসব ক্ষমতা থাকার দরকারটা কী! কিন্তু এখন যদি কেউ বলে, শিকারি সমাজে অর্জন করা নৈতিকতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো সফট স্কিলগুলোও অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি যুগের সঙ্গে আর খাপ খায় না, তাহলে এগুলোও কি আমরা হারিয়ে যেতে দেব?
সেই দক্ষতা যে এখন অচল হয়ে যাচ্ছে, সেটা কিন্তু সোশিওবায়োলজির স্রষ্টা বলে পরিচিত ই ও উইলসন স্পষ্ট করেই বলেছেন- মানুষের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তার আবেগ প্রত্ন-প্রস্তরযুগীয়; তার প্রতিষ্ঠান মধ্যযুগীয়; কিন্তু যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সে বাস করে সেটা অসীম ক্ষমতাধর। ক্ষমতাধর এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চাপে আমাদের প্রস্তরযুগীয় আবেগীয় দক্ষতা যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক।
আমরা যে কারণে প্লেটের খাবারের দিকে নজর দিই না; একই কারণে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদেরও আর আগের মতো খেয়াল করি না। মোবাইল ফোন দেখতে দেখতেই ওদের সঙ্গে কথা বলি। সামনে থাকা মানুষের চাইতে অনলাইনের মানুষ অনেক সময় আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে স্ট্ক্রিনেও যে আমি কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, তা নয়। অনেক মানুষের খবর জানতে গিয়ে কারও প্রতিই আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না। আমি আসলে অনলাইন বা অফলাইন- কোথাও পুরোপুরি থাকি না। সবার সঙ্গেই আছি আবার কারও সঙ্গেই নেই- এক অদ্ভুত ত্রিশঙ্কু অবস্থা। জীবনানন্দ দাশের মতো 'মাথার ভেতরে স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে'। এই বোধটা হলো এক ধরনের ভয়। খরস্রোতা তথ্যপ্রবাহের কোনো তথ্যকণা আমার অজান্তে স্ট্ক্রিন পার হয়ে তথ্যসমুদ্রের অতল তথ্যরাশিতে হারিয়ে গেল কিনা- সেই ভয়।
ভয়টা অমূলক হলেও 'আমি তারে পারি না এড়াতে'। প্রযুক্তি তার চোখ রাখে চোখে। আমি জানি না, আমি কী দেখছি। কিন্তু আমার দেখা বন্ধ হয় না। প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা ইউটিউব ব্যবহার করলেও তার ৩০ শতাংশেরও কম সময় আমি আমার কাজে ব্যবহার করি। বাকি সময়ে ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাকে যা দেখায় তা-ই দেখতে থাকি। সে জানে আমার কী পছন্দ। সে আমার পছন্দের জিনিস একটার পর একটা দেখিয়ে আমাকে আটকে রাখে। আমাকে আটকে রাখাই তার ব্যবসা। ওই একই রকম জিনিস দেখতে দেখতে আমার হাজার বছর ধরে অর্জিত সব মানবিক গুণ হারিয়ে যাচ্ছে কিনা; আমি চিন্তাশক্তিরহিত হয়ে পড়ছি কিনা; অসামাজিক ও অমানবিক হতে হতে আমি অমানুষে পরিণত হচ্ছি কিনা; সেসব নিয়ে প্রযুক্তির কোনো মাথাব্যথা নেই।
ই ও উইলসনের কথার মর্মার্থ হচ্ছে- সোনার পাথরবাটির মতো আপনি যুগপৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লাগামহীন শক্তি বৃদ্ধি ও প্রস্তরযুগীয় আবেগীয় দক্ষতার অস্তিত্ব আশা করতে পারেন না। আপনাকে হয় প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে, না-হয় আপনার সহস্র বছরের সাধনার ধনকে বিসর্জন দিতে হবে। এখন কী করবেন- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও কিন্তু সীমিত। কিছুদিন পর আপনি চাইলেও আর প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরতে পারবেন না। একবার সময় চলে গেলে 'মানুষ' হিসেবে আপনার আর সাধন হবে না।
সৈয়দ মো গোলাম ফারুক: মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক
মন্তব্য করুন