গণফোরামের বিভক্তি সম্ভবত সম্পন্ন হলো গত ১৯ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদ থেকে ড. কামালকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সিদ্ধান্তটি তাঁরা ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ড. কামাল প্রতিষ্ঠিত দলটিকে একাট্টা রাখার শেষ সম্ভাবনাও দৃশ্যত শেষ হয়ে গেল।

গণফোরাম অনেক দিন ধরেই দ্বিখণ্ডিত ছিল। তবে দু'পক্ষই নিজেদের ড. কামালের আশীর্বাদধন্য বলে দাবি করছিল। মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম গত বছরের ৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করে। সেখানে মন্টু নিজে হন সভাপতি এবং দলের একসময়ের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীকে বানানো হয় সাধারণ সম্পাদক। একই কমিটিতে ড. কামালকে রাখা হয় প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। কাউন্সিলের সময় মন্টুর দাবি ছিল- ড. কামালের সম্মতি নিয়েই তাঁরা তা করছেন।

গণফোরামের আরেকটি অংশের নেতৃত্বে আছেন সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। তাঁরাও কাউন্সিল করেন এ বছরের ১২ মার্চ। তবে কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় ড. কামালকে। মোকাব্বির হন নির্বাহী সভাপতি। তাঁরাও তাঁদের কাউন্সিলের পক্ষে ড. কামালের লিখিত সম্মতির কথা জানান।

দলের প্রতিষ্ঠাতার আশীর্বাদ নিয়ে দু'পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি দাবি সত্ত্বেও ড. কামাল নিজে তখন প্রকাশ্যে কিছুই বলেননি। ফলে দলটির সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ক্ষীণ হলেও একটা আশা ছিল- অত্যন্ত প্রাজ্ঞ এ রাজনীতিবিদ তাঁর হাতে গড়া দলটিকে এভাবে ভেঙে যেতে দেবেন না। তিনি পর্দার অন্তরালে হলেও দুই গ্রুপের মধ্যে একটা ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাবেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোকাব্বির খানের গণফোরাম ১০১ সদস্যের একটা পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে। সেখানেও ড. কামালকে সভাপতি পদে রাখা হয়। এ ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। তাই তাঁরা ড. কামালকে তাঁদের কমিটি থেকে শুধু 'অব্যাহতি'ই দেননি; নানা অপ্রিয় বাক্যও বলেন।

ড. কামাল ১৯৯২ সালে মতভিন্নতার কারণে আওয়ামী লীগ ছাড়ার আগে দেশের সবচেয়ে পোড়-খাওয়া দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। দলটির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও লড়েছেন একবার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তরুণ বয়স থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। ফলে ১৯৯২ সালে গণফোরাম প্রতিষ্ঠাকালে জাতীয়ভাবে তাঁর পরিচিতি ব্যাপক ছিল। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা হওয়ার কারণে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও কম ছিল না। উপরি হিসেবে ড. কামালের ছিল আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক যোগাযোগ। এসব কারণেই তাঁর নতুন দলে জনসমাগম বেশ ভালো ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে ব্যাপক সংখ্যায় নেতাকর্মী গণফোরামে যোগ না দিলেও দলটির একসময়ের ডাকসাইটে রাজনীতিক মন্টুর অনুসারীদের বেশিরভাগ সেখানে সমবেত হয়। মস্কোপন্থি ন্যাপ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি থেকেও প্রচুর সংখ্যক নেতা গণফোরামে যোগ দেন।

গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি ড. কামাল এবং তাঁর অনুসারীদের স্পষ্ট অঙ্গীকারের কারণে গণফোরাম প্রথম থেকেই সমাজের উদার গণতান্ত্রিক মানুষদের নজর কাড়ে। বিশেষ করে যাঁরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দক্ষিণপন্থি ঝোঁকের কারণে একটু হতাশায় ভুগছিলেন; তাঁদের মনে গণফোরাম একটা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। গণফোরামের এ সম্ভাবনাটা আরও জোরদার হয়ে ওঠে যখন প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের নেতৃস্থানীয় সব বাম দল একভাবে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ১১ দলীয় জোট গঠন করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে ১১ দলীয় জোটের অধিকাংশ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যে ১৪ দলীয় জোট গঠন করে, সেখানেও ড. কামাল ও গণফোরামের ভূমিকা ছিল বেশ উজ্জ্বল। এক কোটিরও বেশি ভুয়া ভোটার-সংবলিত ভোটার লিস্ট নিয়ে তৎকালীন বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে তাঁর নেতৃত্বাধীন আইনজীবী দল উচ্চ আদালতে নাস্তানাবুদ করে, তা ড. কামালকে বেশ লাইমলাইটে নিয়ে আসে।

কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারোর ছদ্মবেশী সামরিক সরকার ক্ষমতা নিলে তিনি প্রকাশ্যে তাঁদের পাশে দাঁড়ান। তাঁর এ ভুল রাজনীতি তাঁকে ১৪ দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দূরত্ব আরও বাড়ে, যখন ২০১৮ সালে ড. কামাল তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের দল বিএনপির সঙ্গে 'জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট' নামে নির্বাচনী জোট গঠন করেন। এটা ঠিক, এই জোটবদ্ধ হওয়ার কারণেই ওই বছরের জাতীয় নির্বাচনে গণফোরাম দলটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদে প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ পায়। নির্বাচনে গণফোরামের দু'জন নেতা সংসদ সদস্য হন। কিন্তু ওই অর্জন ব্যক্তি হিসেবে সেই দুই সংসদ সদস্যের যতখানি ফায়দা এনে দিয়েছে, গণফোরামকে তার কানাকড়িও দেয়নি। বরং যে সুলতান মনসুরকে দলে ধরে রাখার জন্য ড. কামাল বিএনপি এবং এমনকি গণফোরামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মন্টুসহ অনেক শীর্ষ নেতার তীব্র সমালোচনা উপেক্ষা করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার অনুমতি দেন; সেই সুলতান মনসুরও কিন্তু এখন তাঁর সঙ্গে নেই।


উল্লেখ্য, কারচুপিসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ঐক্য ফ্রন্ট তাদের কোনো সংসদ সদস্য শপথ নেবে না বলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুলতান মনসুরকে শপথ নেওয়ার অনুমতি দিয়ে ড. কামালই তা প্রথম ভাঙেন; পরবর্তী সময়ে জোটের অন্যরাও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। তবে তখনই প্রথমবারের মতো সবাই নিজের দলের ভেতরে ড. কামালের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে দেখল। গণফোরামের ভেতরে ওই যে নেতৃত্বের কোন্দল শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতা আজকের দ্বিখণ্ডিত গণফোরাম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন- একটা দলের প্রতিষ্ঠাতা যখন তাঁরই অনুসারীদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন, তখন সে দলের বিকাশ তো দূর-স্থান; টিকে থাকাই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। কি ডান কি বাম- সব শিবিরেই এর ভূরি ভূরি নজির আছে।

দীর্ঘদিন মূলধারার রাজনীতিতে থাকলেও ড. কামালের সাংগঠনিক কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা তেমন নেই- এটা অনস্বীকার্য। আবার নিজে একটা সম্ভাবনাময় দল গঠনের পরও এ অনভিজ্ঞতা দূর করার চেষ্টা তিনি করেননি। 'সময়ের এক ফোঁড়' কথাটা রাজনীতিকের জন্য বেদবাক্যের মতো। কিন্তু স্বাধীনতার আগে-পরে দেড় দশকের বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাটিয়েও ড. কামাল বঙ্গবন্ধুর এ অনন্যসাধারণ গুণটি আয়ত্তের ধারেকাছে যেতে পারেননি। গণফোরামের বিভক্তি তার সর্বশেষ মাশুল। প্রতিষ্ঠাকালে যথেষ্ট সম্ভাবনা জাগিয়ে যাত্রা শুরু করা দলটি ভবিষ্যতে অন্যান্য ব্র্যাকেটবন্দি দলের মতোই টিম টিম করে জ্বলবে- এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্য।