আমাদের দেশে যাঁরা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প প্রণয়ন করেন, তাঁদের বিশেষত অদূরদর্শিতা নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা কম নেই। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক তৈরি হয়। নির্ধারিত সময়ের কয়েক গুণ সময় নিয়ে এর নির্মাণকাজ শেষ করার পর নীতিনির্ধারকদের মনে পড়ে, মহাসড়কটি ছয় লেনের হলে ভালো হতো। একই পথে ১৯৯০-এর দশকে গোমতী ও মেঘনা নদীর ওপর দুটি সেতু নির্মিত হয়। কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যেই যানবাহনের প্রবল চাপ দেখে কর্তাব্যক্তিদের বোধোদয় হয়, সেতুগুলো অন্তত দ্বিগুণ প্রশস্ত হওয়া উচিত ছিল। প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর ক্ষেত্রে। দুই দশক আগে রাজধানী ঢাকার লাইফলাইন বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে তার অদূরে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সাভারের হেমায়েতপুরে নতুন একটি চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। দুই বছরের এক প্রকল্পও নেওয়া হলো। নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে ছয় গুণ ব্যয়ে সে প্রকল্প ১৯ বছরে শেষও হলো; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, 'আধুনিক' বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সমৃদ্ধ ওই শিল্পনগরীর বর্জ্যে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরীর মুমূর্ষু অবস্থা। জানা গেছে, নতুন এ চামড়া শিল্পনগরীতে প্রতিদিন ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হলেও সেখানে স্থাপিত অ্যাফ্লুয়েন্ট প্লান্টের ক্ষমতা আছে মাত্র ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য শোধনের। আর প্রচুর কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হলেও তা ব্যবস্থাপনার কোনো আয়োজনই সেখানে নেই!
বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন এ চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্যে শুধু ধলেশ্বরী বা আশপাশের খাল-জলাশয় নয়; এলাকার অধিবাসীরাও পড়েছেন কঠিন বিপদে। ফলে তাঁদের দিক থেকে দাবি উঠেছে- হয় বর্জ্য শোধনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করো, নয় এ শিল্পনগরী অন্যত্র সরিয়ে নাও। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীরাও ওই এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে সরকারকে বহুবার যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। গত বছরের আগস্টে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও সভা করে সরকারকে তাগিদ দিয়েছিল পরিবেশ-প্রতিবেশের দূষণ বন্ধে কিছুদিন সাভারের ট্যানারিগুলো বন্ধ রাখার। এর পর একই সংসদীয় কমিটি আবারও চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্যে দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকার এতে কান দেয়নি। তবে এখন সরকার সম্ভবত বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধির চেষ্টা করছে। কারণ বুধবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি মঙ্গলবার এক সভা করেছে। সেখানে শিল্প প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সাভার চামড়া শিল্পনগরীর বাস্তবায়নকারী বিসিক চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে আছে- ট্যানারিগুলোর মধ্যে যেগুলো পরিবেশ-সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলতে অক্ষম; সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং যেগুলো এখনও পরিবেশবিষয়ক প্রত্যয়নপত্রের জন্য আবেদন করেনি সেগুলোকে ছয় মাস সময় দিয়ে ফল দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আমরা জানি, একটা সংসদীয় কমিটি শুধু সুপারিশ বা পরামর্শ দিতে পারে; সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তা মানতে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এবারের সিদ্ধান্তটি সংশ্নিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। সেদিক থেকে সাভার চামড়া শিল্পনগরী বিষয়ে একটা কার্যকর কিছু করা শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য এখন এক প্রকার বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া এ বিষয়টি সবার জানা, বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের পর চামড়া শিল্পই দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা ধারণ করে। আমাদের পণ্যের মানও অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাঁচামালের একটা বড় অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত হওয়ায় এ শিল্পের মূল্য সংযোজনের ক্ষমতাও অন্য অনেক শিল্পের চেয়ে বেশি। কিন্তু কমপ্লায়েন্স বা পরিবেশ-সংক্রান্ত ছাড়পত্র না থাকায় বিশ্বের নামিদামি কোনো ব্র্যান্ড বর্তমানে আমাদের ট্যানারির পণ্য কেনে না। ফলে প্রায় পানির দামে এসব পণ্য বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিতে হয়। বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। তাই পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থেও সরকার দ্রুত সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।