সুন্দরবন অঞ্চলে রূপকথার চেয়ে পুথি, আখ্যান, কিসসা, কিংবদন্তি বেশি প্রচলিত। এসব কিসসায় রাজা, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস চরিত্রগুলো আছে। সব ছাপিয়ে সুন্দরবনের জনপদ আগলে রেখেছে বনবিবির আখ্যান। গল্পের আসরে একটি হলেও দুঃখে, দক্ষিণ রায়, শাহজঙ্গলী, শাহজামাল, পীরবদর, খোয়াজখিজিরদের কাহিনি থাকবে। কীভাবে দক্ষিণ রায় বাঘের রূপ ধরে আসে, মা বনবিবি কীভাবে জঙ্গলের ভেতর শিশু দুঃখেকে বাঁচায়- শুনতে শুনতে কত রাত কেটে গেছে!
সুন্দরবন লাগোয়া উপকূলের গ্রামগুলোতে এখন আর আগের মতো পুথি-গল্পের আসর নেই। কে কার কাছে করবে গল্প- যদি বছর বছর ঘূর্ণিঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়; সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস এভাবে একের পর এক সাইক্লোন হয়; লবণপানিতে তলিয়ে যায় গৃহস্থালি থেকে গল্পের থলি? উন্নয়ন মারদাঙ্গায় গত ৪০ বছরে ওলটপালট হয়েছে উপকূলের ভূগোল, জনমিতি, উৎপাদন ও সংস্কৃতি। জীবন আর টিকে থাকা আরও বেশি জটিল ও কঠিন হয়ে পড়ছে জলবায়ুজনিত সংকটের কারণে। দলে দলে গ্রাম ছাড়ছে পুরুষ। নোনাজলে জাল ঠেলে; ঘেরবেড়ি, বাদায় কাজ করে সময় যায় নারী, শিশু, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ়ের। সুন্দরবন উপকূলে এখন গল্প বলা ও শোনার মানুষ উভয়েই কমছে।
বাদাবনের জনপদে বহু কিসসার অন্যতম চরিত্র হলো 'রাজকন্যা'। নোনাবাদার উপকূলের মানুষ কিন্তু এসব চরিত্র দেখেনি কখনও। শুনেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধূমঘাটে ছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। সেই রাজকন্যার কথা জানাও যায় না। গল্পগাথার রাজা, রানী, রাক্ষস, রাজপুত্র কি রাজকন্যার সঙ্গে উপকূলের সাক্ষাৎ ঘটেনি কোনোকালে। কিন্তু বাস্তবের এক রাজকন্যার সঙ্গে শ্যামনগর উপকূলের মানুষের দেখা হয়েছিল।
করোনা মহামারির ভেতর ২০২২ সালের এপ্রিলে ডেনমার্কের রাজকন্যা ম্যারি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন বাংলাদেশে এসেছিলেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, আতিথেয়তা ও কাজ সেরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং জলবায়ুদুর্গত মানুষের টিকে থাকার লড়াই জানতে-বুঝতে তিনি শ্যামনগর আসেন গত ২৬ এপ্রিল। কুলতলী গ্রামে ঘুরেছেন তিনি। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন; দাঁতিনাখালীতে ভাঙন দেখেছেন; গ্রামীণ জনপদের অভিযোজন বোঝার চেষ্টা করেছেন; সুন্দরবন দেখেছেন।
ডেনিশ রাজকন্যার আগমনে 'সাজ সাজ' রব পড়েছিল শ্যামনগরে। ধানখালী গ্রামের কৃষিজমিনে তিনটি হেলিপ্যাড বানানো হয়েছিল। নিরাপত্তা হয়েছিল জোরদার। রাজকন্যা চলে গেছেন, বহুদিন হলো। কিন্তু এখনও ধানখালীর কৃষিজমি থেকে সেই তিনটি হেলিপ্যাড সরেনি। কোনো ক্ষতিপূরণও পাননি জমির মালিকরা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের এক প্রাচীন কৃষিগ্রাম ধানখালী। গ্রামের সুখচান মণ্ডলদের প্রায় তিন বিঘা জমি আছে ধানখালীর চকে। সুখচানের ছেলে রবীন্দ্রনাথ খুলনার কুইয়ের বাজার এলাকায় বোরো মৌসুমের ধান কাটার মজুর হিসেবে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে দেখেন, ধানখালী চকে কৃষিজমিতে হেলিপ্যাড করা হচ্ছে। তাঁদের ৮ কাঠা জমি নেওয়া হয়েছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়; গ্রামের রাধাকান্ত গায়েন, নিরাপদ গায়েন, প্রাণকৃষ্ণ গায়েন, নিহারচন্দ্র গায়েন, বাবু গায়েন, অমিয় গায়েন, অমিত গায়েন, নিরাপদ মণ্ডল, আতিয়ার রহমান, শম্ভুচরণ মণ্ডল, ব্রজেন্দ্রনাথ মণ্ডল, সুশীল মণ্ডল, অনাদি মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, অনিল মণ্ডল, সাধন মণ্ডল, অনাদি মণ্ডলের পরিবারের জমিও নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি হেলিপ্যাডের জন্য প্রায় আড়াই বিঘা জমি লেগেছে। তিনটির জন্য প্রায় সাত বিঘা।
হেলিপ্যাডের কারণে ১৪২৯ বাংলায় ধানখালীর সাড়ে সাত বিঘা জমিতে ধান আবাদ হয়নি। জমি বন্দি না হলে কমপক্ষে ১৪০ মণ ধান পেত ধানখালী গ্রাম। গ্রামবাসী জানালেন, তাঁরা কেউ প্রতিবাদ করেননি প্রথম। কিন্তু এতদিন জমি এভাবে বিনষ্ট হবে- এতে কৃষক হিসেবে তাঁদের মনে যন্ত্রণা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন- দেশের ১ ইঞ্চি জায়গাও যেন খালি পড়ে না থাকে। কৃষিজমি সুরক্ষায় রাষ্ট্র একটি আইনও খসড়া করেছে। সেখানে ডেনিশ রাজকন্যার আগমনে বানানো হেলিপ্যাড প্রায় সাড়ে সাত বিঘা জমি বন্দি করে রেখেছে। জলবায়ুদুর্গত উপকূলে লবণাক্ততা ও চিংড়ি ঘেরের কারণে কমছে কৃষিজমি। আর সেখানে হেলিপ্যাডের নামে জমিকে অনাবাদি করে রাখা ন্যায়সংগত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ডেনমার্কের মতো উত্তরের ধনী দেশ দায়ী; বাংলাদেশের মতো দক্ষিণের কোনো দেশ নয়। উত্তরের ধনী মানুষের ভোগবিলাসী জীবনই আজ এই মাতৃদুনিয়াকে এক নিদারুণ যন্ত্রণায় ফেলেছে। দায়ী না হয়েও জলবায়ু বিপর্যয়ের আঘাত সইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শ্যামনগরের মতো উপকূলে মানুষ লবণপানি, ঘূর্ণিঝড় আর দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিদিন লড়ছে।
ডেনিশ রাজকন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপদ ও মানুষের দুর্দশা বুঝতে এসেছেন; গ্রামীণ জনপদের টিকে থাকার লড়াইয়ে সহযোগিতা করছেন- এসব খুবই আশাব্যঞ্জক। এ কারণে আমরা বহুবার তাঁকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু একটি জলবায়ুবিপন্ন জনপদে তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে কিছু গরিব কৃষকের জমি বহুদিন অনাবাদি হয়ে থাকবে- সেটি কোনোভাবেই আশা করা যায় না।
জানি, এর সঙ্গে রাজকন্যার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এই ঘটনাটি জানলে হয়তো তিনিও কষ্ট পাবেন। যাঁরা স্থানীয়ভাবে রাজকন্যার সফর আয়োজন ও সমন্বয় করেছেন; হেলিপ্যাড নির্মাণ এবং এটি সরানোর দায়িত্বে আছেন- এভাবে দীর্ঘদিন কৃষিজমি অনাবাদি রাখার যন্ত্রণা তাঁদের বোঝা জরুরি ছিল। রাজকন্যার পরিদর্শন শেষেই দ্রুত দায়িত্বপ্রাপ্তরা কৃষিজমি থেকে হেলিপ্যাডগুলো সরাতে পারতেন। পাঁচ মাস ধরে প্রশ্নহীনভাবে কৃষিজমি দখল করে আছে হেলিপ্যাডগুলো। এমনকি স্থানীয় জনগণের কোনো কাজেও আসছে না এসব সাময়িক স্থাপনা। নিজের জমিতে কৃষিকাজ করতে পারছে না বেশ কিছু পরিবার। আশা করি, সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। ধানখালীর কৃষিজমি থেকে ডেনিশ রাজকন্যার সফর উপলক্ষে বানানো হেলিপ্যাডগুলো দ্রুত সরিয়ে নিতে সক্রিয় হবে।
হেলিপ্যাডগুলো সরিয়ে নিলেই জমি সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের শ্রেণিচরিত্র ফিরে পাবে না। কারণ হেলিপ্যাডের জন্য দেড় ফুট গভীর করে জমিতে বালু ফেলা হয়েছে। ইট, সিমেন্ট জমিতে ঢালা হয়েছে। দীর্ঘ সময় মাটি চাপা পড়ে ছিল। জমিগুলোকে আবারও উর্বর, হিউমাসসমৃদ্ধ করতে এবং আগের শ্রেণিরূপ ফিরিয়ে আনতে আশা করি, কৃষকরা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাবেন।
ধনী দেশ যেমন জলবায়ু তহবিল আর কার্বন হ্রাস বিষয়ে বছর বছর মিথ্যা আশ্বাস দেয়; তেমনি ধানখালীর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে শুনে আসছেন- তাঁদের জমি মুক্ত হবে। কিন্তু হচ্ছে না।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com