
'থাকত যদি এই শহরে/নিজের একটা বাড়ি/মনের রঙে রাঙিয়ে দিতাম/দেয়ালটাকে তারই। লাল হবে না সবুজ হবে/পছন্দ আমার/নিজের বাড়ি সে তো আমার/ভালোবাসার খামার। রাত্রি করেই ফিরব বাড়ি/থাকবে দুয়ার খোলা/গোমড়া মুখে থাকবে না তো/কিপটে বাড়িওয়ালা।' জুলফিকার রাসেলের কথায় ও বাপ্পা মজুমদারের কণ্ঠে এই গানটির কথা মনে পড়ল সমকালে ৩ অক্টোবর প্রকাশিত 'ঢাকার ৭০% মানুষের নেই নিজের ঘর' শিরোনামে সংবাদটি পড়ে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ মানুষ নিজের বাসাবাড়িতে বাস করেন। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের নিজের ঘর নেই।
দেশের সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে রাজধানী ঢাকায় ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষের বাস। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ নিজস্ব আবাসনের বাইরে। এদের নেই নিজস্ব কোনো ঘর বা বাড়ি। বিষয়টি নিয়ে এমন সময়ে আলোচনা সামনে এলো, যখন সম্প্রতি পালন করা হলো 'বিশ্ব বসতি দিবস'। ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার 'বিশ্ব বসতি দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য- 'বৈষম্য হ্রাসের অঙ্গীকার করি, সবার জন্য টেকসই নগর গড়ি'। আমাদের সরকার স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-শিক্ষা খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এসব মৌলিক চাহিদার মতো বাসস্থানও একটি। তবে রাজধানীবাসীর আবাসনের জন্য সরকার এ খাতে কখনও কোনো ভর্তুকি দেয়নি। রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষের নিজের ঘর না থাকার সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির চিত্র বেমানান বলেই মনে হয়।
আমরা জানি, দেশের মানুষ ঢাকামুখী। উচ্চ শিক্ষা, চাকরিপ্রাপ্তি, সুচিকিৎসা থেকে শুরু করে নানা কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত মফস্বল থেকে রাজধানীতে আসে। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত যেমন- নদীভাঙনসহ বিবিধ কারণে রাজধানীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এসব মানুষের রাজধানীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে না। তাঁরা বস্তি, ফুটপাত, বাস-লঞ্চ-ট্রেন স্টেশনে বাস করছেন। সরকারি হিসাবে রাজধানীর জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ৪০ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করেন। সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার ওপর ঘর তুলে তাঁরা বাস করেন। এ রকম লোকের সংখ্যা রাজধানীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রায় কারোরই রাজধানীতে নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজধানীতেও মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করে থাকেন। তবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ভাড়াটিয়ার সংখ্যা যে হারে রয়েছে, তা একেবারেই ভারসাম্যহীন। এখানে নিজস্ব বাসস্থানহীন মানুষ ৭০ শতাংশেরও বেশি। এসব মানুষের পক্ষে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁদের আয়ের ৪০-৫০ শতাংশই চলে যাচ্ছে আবাসন খরচে। ফলে তাঁরা যুগের পর যুগ নিজস্ব আবাসনের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। এই ঘরহীন মানুষের জন্য সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এভাবে দীর্ঘদিন বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কেননা, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসমষ্টিকে পিছিয়ে রেখে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই ভারসাম্যহীন অবস্থা পরিবর্তনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি তাঁদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে বাড়ি তৈরির সুযোগ রাখা উচিত।
আমরা দেখছি, দেশে বেসরকারি আবাসন প্রকল্প ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে এই খাতে বড় বিনিয়োগও লক্ষ্য করার মতো। তাই রাজধানীতে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে হাউজিং প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। বিপুলসংখ্যক মানুষের আবাসন সরকারের একার পক্ষে করাও সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার অর্থায়নের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পারে। সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাজধানী ঢাকায় মানুষের মধ্যে আবাসস্থলের যে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, তা দূর করা সহজ হবে।
এহ্সান মাহমুদ : সমকালের সহ-সম্পাদক
মন্তব্য করুন