ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে নির্বাচন আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ঘোষণা অনুসারে ফল ঘোষণা করা হবে ১৯ অক্টোবর। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী আছেন দু'জন- নেহরু-গান্ধী পরিবারের নিষ্ঠাবান অনুসারী এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খারগে, যিনি রাজ্যসভার বিরোধী দলের নেতাও বটে এবং লোকসভার কংগ্রেসদলীয় সাংসদ শশী থারুর। লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বেশ জনপ্রিয় শশী থারুর দলের ভেতরে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত জি-২৩ গোষ্ঠীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। খারগে গান্ধী পরিবারকে কতটা মানেন- এর প্রমাণ হিসেবে অনেকে বলেন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের তিনজনের নাম রাখা হয়েছে রাহুল, প্রিয়াঙ্কা ও প্রিয়দর্শিনী। রবিঠাকুর ইন্দিরাকে প্রিয়দর্শিনী নাম দিয়েছিলেন।
গান্ধী পরিবারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে কোনো বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে তাদের সমর্থন নেই বলা হলেও সবাই বিশ্বাস করে যে, খারগে আসলে গান্ধী পরিবারেরই প্রার্থী। আর যতই পরিবারতন্ত্র নিয়ে সমালোচনা থাকুক; এটাই বাস্তব, গান্ধী পরিবার যেদিকে, কংগ্রেস নেতাকর্মীর বেশিরভাগ সেদিকেই থাকবে। ফলে এ নিয়ে বিশ্নেষকদের মধ্যে দ্বিধা খুব কমই আছে যে, ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলটির পরবর্তী সভাপতি অর্থাৎ সোনিয়া গান্ধীর উত্তরসূরি হতে চলেছেন ৮০ বছর বয়সী মল্লিকার্জুন খারগে।
দলের সভাপতি পদে গান্ধী পরিবারের প্রথম পছন্দ ছিল সংগঠক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ রাজস্থানের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট। কিন্তু দলের ভেতরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে না চাওয়ায় সভাপতি নির্বাচনের দৌড় থেকে ছিটকে পড়তে হয় তাঁকে। হিন্দি বলয়ের আরেক প্রবীণ নেতা দিজ্ঞ্বিজয় সিং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য গান্ধী পরিবারের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধী পরিবার তাঁকে বাদ দিয়ে বেছে নেয় দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের প্রভাবশালী নেতা খারগেকে। বিশেষ করে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে দিজ্ঞ্বিজয়ের ভাবমূর্তি খুব একটা ভালো নয়। তাঁর বিরুদ্ধে কথিত মুসলিম তোষণের অভিযোগ প্রবল। আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে একবার বেশ সম্মান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন তিনি।
আইনে স্নাতক খারগে কর্ণাটক বিধানসভায় টানা ৯ বার (১৯৭২-২০০৮) নির্বাচিত হয়েছিলেন। লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন দু'বার- ২০০৯ ও '১৪ সালে। ২০১৯ সালে লোকসভায় হেরে গেলে তাঁকে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য করা হয়। একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও পরিস্থিতি অনুসারে কাজ করতে সিদ্ধহস্ত নেতা হিসেবে খ্যাতিসম্পন্ন খারগে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারে ছয়বার মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, দলিত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এ নেতা সভাপতি হিসেবে কংগ্রেসের জন্য একটা মূল্যবান সম্পদ হবেন।
আরও যেসব কারণে কংগ্রেস হাইকমান্ড খারগেকে সভাপতি পদে তুলে আনতে প্রত্যাশী, সেগুলোর মধ্যে নিচের পাঁচটি কারণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :
১. এ মুহূর্তে কংগ্রেস চায় এমন একজনকে, যিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন। অত্যন্ত প্রবীণ ও পোড়খাওয়া নেতা হিসেবে দলের নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তাঁর আছে; যে কাজটি রাহুল পারছিলেন না। জি-২৩সহ দলের অনেক প্রবীণ নেতা রাহুলের ওপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না। অনেকে এ কারণেই দল ছেড়েছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার সময় রাহুল বলেছিলেন, তাঁকে একাই ওই নির্বাচনী যুদ্ধে লড়তে হয়েছে। উল্লেখ্য, জি-২৩ভুক্ত শশী থারুর খারগের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও ওই 'বিদ্রোহী' গোষ্ঠীর বাকি সবাই খারগের পক্ষে কাজ করছেন।
২. খারগেকে নিয়ে দলের ভেতরে তো বটেই, বাইরেও কোনো বিতর্ক নেই। আবার কংগ্রেসের এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ছাড় দিয়ে কথা বলেননি তিনি।
৩. দল ও গান্ধী পরিবারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশ্নাতীত- এ কথা আগেই বলা হয়েছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনোই তিনি গান্ধী পরিবারের নির্দেশনার বাইরে যাননি। ১৯৯৯ ও ২০০৪- দু'বারই তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদের অগ্রগণ্য প্রার্থী ছিলেন; কিন্তু তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। তার পরও দলের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ দেখাননি। বরং ২০০৫-২০০৮ সালে তিনি কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালে বিধানসভা নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করে কংগ্রেস।
৪. ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল করতে হলে কংগ্রেসকে দক্ষিণ ভারতে ভালো করতে হবে, যার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য কর্ণাটক। সেখানে বাসাভরাজ বনমাইয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার এরই মধ্যে সবকিছুতে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছে। ফলে কংগ্রেসের জন্য একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কর্ণাটক বিধানসভা জয়ের। খারগে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সভাপতি হলে তা নিশ্চিতভাবে ওই পালে হাওয়া দেবে।
৫. মল্লিকার্জুন খারগের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাঁর দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার স্মারক পদবি। শুধু কর্ণাটকে নয়; সারা ভারতের দলিতদের মধ্যে তিনি খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। একটা সময় ছিল যখন ব্রাহ্মণ ও সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি দলিত সমর্থক বেজ কংগ্রেসকে ক্ষমতায় থাকতে সহয়তা করেছিল। বিশেষ করে উত্তর ভারতে ১৯৯০ সালের দিকে মণ্ডল সম্প্রদায় ও রামমন্দিরকেন্দ্রিক রাজনীতির উত্থানের পরিণামে কংগ্রেস ওই সামাজিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। অন্য বর্ণহিন্দুদের পাশাপাশি ব্রাহ্মণরাও বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ে; উত্তরপ্রদেশে দলিতরা চলে যায় মায়াবতীর বিএসপি শিবিরে। উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেসের মাত্র ৩ শতাংশ ভোট প্রাপ্তি এরই সাক্ষ্য বহন করে। সভাপতি পদে খারগের নির্বাচন কংগ্রেসের প্রতি দলিতদের আস্থা ফেরানোর একটা ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে। বিজেপি যেমন দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রে, যেখানে পরিচয়ের রাজনীতি বা আইডেন্টিটি পলিটিক্স প্রাধান্য বিস্তার করে আছে; খারগের কংগ্রেসের সভাপতি হওয়া একটা বড় ঘটনা হতে পারে।
বলা হতে পারে, পাঞ্জাবে দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত চরণজিৎ সিং চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানোর পরও কংগ্রেস গোহারা হেরেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাঞ্জাবে পরাজয়ের জন্য চান্নি যতটা দায়ী, এর চেয়ে বেশি দায়ী নভজোত সিং সিধু, যিনি যে কোনো মূল্যে চান্নির জয় ঠেকানো হবে বলে রীতিমতো পণ করেছিলেন। সিধুকে বাদ দিয়ে কেন চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলো- এ নিয়ে সিধু ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর খারগে কিন্তু চান্নি নন। তিনি অনেক বেশি বিচক্ষণ। উপরন্তু কংগ্রেসের জাতীয় পর্যায়ে কোনো সিধু নেই।
যাঁরা বলছেন, সভাপতি হিসেবে খারগের কোনো ক্ষমতা থাকবে না; তিনি হবেন গান্ধী পরিবারের পুতুল মাত্র, তাঁদের মনে রাখা দরকার- আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, গান্ধী পরিবারই এ মুহূর্তে কংগ্রেসের প্রাণ। বিজেপির অস্তিত্ব যেমন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ-আরএসএস ছাড়া চিন্তা করা যায় না, তেমনি গান্ধী পরিবার ছাড়াও কংগ্রেসকে ভাবা যায় না।
আশুতোষ: 'হিন্দু রাষ্ট্র' বইয়ের লেখক এবং সত্যহিন্দি ডটকম পোর্টালের সম্পাদক। এনডিটিভি ডটকম থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন